দক্ষিণ বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ
কপোতাক্ষ নদের তীরে ইাতহাসের স্বাক্ষী ঐতিহাসিক মসজিদকুড় মসজিদ

খুলনা জেলা থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার বহু প্রাচীন গ্রাম আমাদী। কপোতাক্ষ নদের পূর্ব পারের এই গ্রামকে ইতিহাস প্রসিদ্ধ করে তুলেছে ঐতিহাসিক মসজিদকুড় মসজিদ। যাকে বুড়ো খাঁ মসজিদও বলা হয়। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে মাটি খুঁড়ে মসজিদটি বের করায় মসজিদের এ নাম দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, ১৪১৮ -১৪৩২ খিষ্টাব্দে গৌড়ের সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ। এই সময়ে হযরত খানজাহান আলী (রহঃ) দক্ষিণ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। বাগেরহাট অঞ্চলের শাসক ও সুফি সাধক খান জাহান আলী (রহঃ) এর আমলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তাঁর শিষ্য বুড়া খাঁ ও ফতেহ খাঁ এই গ্রামে কাছারি করে এলাকা শাসন করতেন ১৪৫০ -১৪৯০ সালের সময়কালে। তাঁরা এখানে একটি ৯ গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। ইট সুরকির তৈরি মসজিদটি দক্ষিণ বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন প্রতœসম্পদ। মসজিদের দক্ষিণে এই দুই কর্মকর্তার কাচারি এবং সমাধি ছিল, যা এখন কপোতাক্ষ নদের বুকে নিমজ্জিত। পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদের পাশে সিকান্দার শাহের বর্গাকার ৯ গম্বুজ বিশিষ্ট সমাধিসৌধের সঙ্গে এ মসজিদের মিল নির্মাণ কৌশল ও পরিকল্পনায় সাদৃশ্য রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় এলাকাবাসীসহ দূরদূরান্ত থেকে আজও বহু মানুষ আসেন শিল্পীর নিপুন হাতের ছোয়ায় গড়া অপরুপ স্থাপত্য শৈলীর এ মসজিদে নামায আদায় করতে। নজরকাঁড়া সৌন্দর্যমন্ডিত মসজিদটির রয়েছে ৯ টি গম্বুজ। মসজিদটির তিনপাশে তিনটি প্রবেশ পথের সঙ্গে রয়েছে আরও ছয়টি ছোট প্রবেশ পথ। তবে এখন উত্তর ও দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়ে শুধু পূর্ব দিকের প্রবেশ পথ দিয়েই মুসল্লিরাসহ দর্শনার্থীরা মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন। তবে পুরো মসজিদ টি বর্গাগার। প্রতি পাশের মাপ হচ্ছে ১৬ দশমিক ৭৬ মিটার, ভেতরের মাপ ১২ দশমিক ১৯ মিটার করে। প্রতিটি দেয়াল প্রায় ৭ ফুট প্রশস্ত। কেবলামুখি দেয়ালে বাদে তিনটি দেয়ালেই প্রবেশের জন্য তিনটি করে খিলান প্রবেশদ্বার রয়েছে। খিলানগুলোর পাশের কোনা ভরাট করা হয়েছে ইটের নির্মিত পেনেইন্টভ দ্বারা। তবে মাঝের প্রবেশদ্বার গুলো অপেক্ষাকৃত অন্য গুলোর তুলনায় বেশ বড়। কেবলামুখি দেয়ালে অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব তৈরি করা হয়েছে। মাঝের মেহরাব অপেক্ষাকৃত বড়। মসজিদের খেতরের চারটি স্তম্ভের ওপর ছাদ ভর করে আছে। এই চারটি স্তম্ভ মসজিদের ভেতরের অংশকে নয়টি সম বর্গক্ষেত্রে ভাগ করেছে। বর্গক্ষেত্রগুলো গম্বুজ দিয়ে ঢাকা। মসজিদের মৌলিক কাঠামো ইটের তৈরি । বাইরের চার কোনের গোলাকার বুরুজ ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। মসজিদটি একসময় টেরাকোটা দিয়ে সজ্জিত ছিল। এগুলো অনেকটাই কালের গর্বে বিলীন হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানায়, এক সময় মসজিদের স্তম্ভগুলোতে এলাকাবাসী তৈল লাগিয়ে তা নিয়ে যেতেন। যদিও কুসংস্কার তবুও তারা বিশ্বাস করতেন, এই তৈল গায়ে মাখলে বা খেলে অনেক রোগব্যাধী থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। তবে তৈল মাখাতে মাখাতে স্তম্ভগুলো ক্রমশ সরু হতে থাকায় পরবর্তীতে তা ইট সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সেখানে বিভিন্ন ধরনের মানতও করা হত। তবে সর্বশেষ এগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মসজিদকুড় গ্রামের প্রবীনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে অত্র এলাকার জঙ্গলের কাঠ কেটে কলকাতায় বিক্রি করা হতো। এ সময়ই মূলত কাঠ কাটতে গিয়ে মসজিদটির সন্ধান মেলে।
মসজিদের খাদেম আবুল কালাম সানা বলেন, অত্র এলাকায় সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শন এটি। যার ফলে প্রতিদিনি নিদর্শনটি দেখতে বাইরে থেকে বহু মানুষ আসে। তবে শুক্রবারে বেশ জমজমাট থাকে। এখানে আমার বাপ দাদারা এ মসজিদের খেদমত করে গেছেন। তাই আমিও এমন প্রাচীন মসজিদের দায়িত্ব পালন করতে পেরে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করেন বলেও প্রকাশ করেন তিনি।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ গোটা মসজিদকে একটি কমপ্লেক্স হিসেবে গড়তে পারলে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে মসজিদকুড় মসজিদ। আর এমনটি হলে সুন্দরবন কেন্দ্রীক পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাবে। আর তাই দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে মসজিদকুড়ের রক্ষণাবেক্ষণ সরকারের প্রত্নতত্ত¡ অধিদফতর করলেও এটিকে দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করতে সকলের আন্তরিকতা ও সংশ্লিষ্টদের স্বদিচ্ছার দাবি জানান স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষ।
বাখ//আর