পদ্মা-যমুনার প্লাবনভূমি বড়াল নদীর বুকে ধানচাষ হচ্ছে

দখল দূষণ ও উৎসমূখে স্লুইসগেট নির্মাণ করায় পদ্মা-যমুনার প্লাবনভূমি বড়াল নদীর বেশিরভাগ অংশ শুকিয়ে গেছে। এককালের খরস্রোতা বড়ালের বুকে হচ্ছে ধানচাষ। এই নদী রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে ২০৪ কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়ে পাবনার বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জে যমুনা নদীতে মিলিত হয়েছে। বনপাড়া ভূমি রাজস্ব অফিস বড়াল নদীর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর জমি দখল করে করা হয়েছে হাউজিং সোসাইটি। মজে যাওয়া নদীর অবৈধ দখলে চলে যাওয়া প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা পাকাপাকিভাবে দখলে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টরা তদবির করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাজশাহীর চারঘাটে স্লুইসগ নির্মাণ করার পর পানি প্রবাহ কমে গেল। পদ্মার পানি বড়ালে আসা বন্ধ হলো। বন্ধ হলো যমুনার পানি বাড়ার সময় পানির চলাচল। বড়াল সংযুক্ত ১৬ নদী, ৩৯ বিল ও ২২ খাড়ির ৭৫ ভাগ অংশ শুকিয়ে গেছে। নদী পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। তেমনি এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকায় ফেলেছে মারাত্মক প্রভাব। বড়াল মজে যাওয়ায় দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্রকে করেছে বিপর্যস্ত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকায় ফেলেছে মারাত্মক প্রভাব। নদী-বিলকেন্দ্রীক ব্যবসা-বানিজ্য ও সেচ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
পদ্মা এবং যমুনা নদীর সংযোগ রক্ষাকারী বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য দু’শ চার কিলোমিটার। পদ্মার শাখা ও চলনবিলের প্রধান পানি সরবরাহকারী নদী হচ্ছে বড়াল। নদীটি রাজশাহীর চারঘাট পদ্মা থেকে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুশাখা, নারদ, নন্দকুজা, চিকনাইসহ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে পাবনার চাটমোহর ভাঙ্গুড়া,ফরিদপুর উপজেলা হয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী হয়ে যুমনা নদীতে মিশেছে।বড়াল পাবনার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। বড়াল অববাহিকায় ধান, চাল, মসুর, খেসারি, সরিষা, মাস কালাই চাষে সারা দেশে সুখ্যাতিলাভ করে। বড়াল পাড়ের ফসল নৌপথে চাঁদপুর, চট্টগাম, ঢাকা, নারয়ণগঞ্জ ও খুলনায় পাঠানো হয়।তাই বড়ালের ধারে চারঘাট, পুঠিয়া, বাগাতিপাড়া, দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্ট, বড়াইগ্রাম, বনপাড়া, রামনগর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, মির্জাপুর, জোনাইল, বাঘা, ডেমড়া, সিলন্দাতে নদী বন্দর গড়ে উঠে। আশির দশকের শুরুর দিকেও বড়াল দিয়ে বড় বড় নৌকা, বার্জ, কার্গোতে পণ্য সামগ্রী আনা-নেয়া হতো। বড়াল নদীর ইলিশ মাছ, পাবদা, চিংড়ি, চিতল, আইড় ও বোয়াল মাছের ছিল ব্যাপক সুখ্যাতি। এখন নদীটি বলা চলে মাণচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে। বর্ষায় ২ মাস পানি থাকলেও সারা বছর বলা চলে বড়াল পানি শুন্য হয়ে পড়ে। তখন চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া অংশে ধান চাষ করা হয়।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়াল বেসিন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে নির্মাণ করে ক্লোজার বা তিন দরজা বিশিষ্ট স্লুইসগেট। পদ্মা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া বড়াল নদী’র স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করা হয় ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি পাঁচ দরজা বিশিষ্ট স্লুইসগেট নির্মাণ করে। এই গেইটটি নির্মাণ করার ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তরের অংশে পানি চলাচল একবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ নন্দকুঁজা এবং অপর ভাগ বড়াল। এখানেই বড়ালের মুখে নির্মাণ করা হয় এক দরজা বিশিষ্ট একটি স্লুইসগেট। একদিকে বড়ালের উৎসমুখে চারঘাটে স্লুইসগেট, অন্যদিকে দীর্ঘদিন এত বড় একটি নদীর মুখে এক দরজার একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করায় বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। নদীর ভাটিতে বড়াল নদীর উপর তৃতীয় ও চতুর্থ স্লুইসগেট গেইট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুরা এবং চাটমোহরের দহপাড়ার নিকটে। দহপাড়ার নিকটবর্তী স্লুইসগেটটির উভয় পার্শ্বই শুকিয়ে যায় শুকনো মৌসুমে। যেহেতু নদীটিকে এভাবে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।
নদীর ভাটিতে বড়াল নদীর উপর তৃতীয় ও চতুর্থ স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুরা এবং চাটমোহরের দহপাড়ার নিকটে। দহপাড়ার নিকটবর্তী স্লুইস গেইটটির উভয় পার্শ্বই শুকিয়ে যায় শুকনো মৌসুমে। যেহেতু নদীটিকে এভাবে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। অতএব এর পর যা হওয়ার তাই হয়েছে। যে যেখানে যতটুকু পারে নদী দখল করেছে। নদীর মধ্যে ঘর-বাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছে। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীর পানি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ করছে।
চাটমোহর উপজেলার গুনাইগাছা, বোঁথড়, নতুন বাজার খেয়াঘাটসহ বেশকিছু এলাকায় স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বড়াল নদীর এসব চিত্রের কথা। গুনাইগাছা গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ জানান, একসময় বড়াল নদীর পানি দিয়ে চলতো আমাদের কৃষি কাজ। এখন সেই নদীতে পানি না থাকায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। এর বিকল্প হিসেবে নদীর তীরে ফলজ বাগান গড়ে তোলা হলেও পানির অভাবে ফলন ভাল হচ্ছেনা। নতুন বাজার খেয়াঘাট এলাকার মৎসজীবী সুবল হালদার বলেন, চলনবিল ও বড়াল নদীর সুস্বাদু মাছের চাহিদা ও খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। এই নদীর মাছ বিক্রি করে সংসার চলতো আমাদের। অনেক মৎসজীবি ছিল এলাকায়। এখন নদী বন্ধ। মাছ নেই।
নদী মরে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশাল চলনবিলে। চলনবিলের প্রসিদ্ধ মৎস্য সম্পদ হ্রাস পেয়েছে। বিশাল গবাদী পশুর চারণভূমিতে আগের মতো মাসকালাই ও খেসারী ঘাস জন্মে না। তাতে গবাদীপশু সম্পদ মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। শুকনো মৌসুমে বড়ালে পানি প্রবাহ না থাকায় বিল শুকিয়ে যায়। বিলে পানির সঙ্কট দেখা দেয়। চাষী ও মৎস্যজীবীদের নানা সমস্যায় পরতে হয়েছে। জেলে সম্প্রদায় এখন বিলুপ্ত প্রায়। উত্তরাঞ্চলের মৎস্য ভা-ার হিসাবে পরিচিত চলন বিলে ৭০ থেকে ৭৫ প্রকার মাছ পাওয়া যেতো। এখন তার অনেক প্রজাতিই বিলুপ্ত প্রায়।
বাখ//আর