বৃহত্তম চলনবিলে এবার রেকর্ড পরিমাণ মধু ও সরিষা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে

দেশের বৃহত্তম বিল হিসেবে পরিচিত চলনবিল। বিলটি পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। উত্তর জনপদের এক বিরল প্রাকৃতিক জলসম্পদ এটি। এই বিলটি এক সময় বছরের নয় মাস পানিতে ডুবে থাকতো। চলনবিল তার বিশাল জলরাশির ঐতিহ্য হারিয়েছে। বিলের তলা উন্মোচিত হয়েছে। এখন প্রকৃতির হলুদ ও সবুজ রং ছড়িয়ে পড়েছে চলনবিলের চারদিকে। চলনবিলের বুকজুড়ে রবি মওসুমে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। সেই সরিষার ফুল থেকে আহরিত হচ্ছে অনন্য সম্পদ মধু। চলতি মওসুমে এ অঞ্চলে প্রায় আড়াই হাজার টন ও তিন লাখ টন সরিষা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই মধু ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়ে থাকে বলে ভ্রাম্যমান মধু সংগ্রহকারীরা জানিয়েছেন।
চলনবিলের মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো থোকা থোকা হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠগুলো যেন হলুদ চাদরে মোড়ানো। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে প্রকৃতির রুপ। প্রান্ত জুড়ে উঁকি দিচ্ছে সরিষা ফুলের দোল খাওয়া গাছ। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল শিশির ভেজা শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকমিকিয়ে উঠছে। যেন প্রকৃতি সেজেছে হলুদবরণ সাজে। হলুদ রঙের আভার সাথে বাতাসে বইছে মৌ মৌ গন্ধ। মৌমাছি ব্যস্ত মধু সংগ্রহে। চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা সপরিবারে ভিড় করছেন মাঠে, তুলছেন ছবি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মৌচাষিরা মধু সংগ্রহে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মৌ বাক্স স্থাপন করেছে। স্থানীয়রা জানান, চলনবিলের প্রধান অর্থকরী সম্পদ এখন মাছ নয়, মধু।
কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মওসুমে পাবনায় ৪৪ হাজার ৮৯০ হেক্টর, নাটোরে ৯ হাজার ১১৫ হেক্টরে, নওগায় ৬০০ হাজার ১০০ হেক্টর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ৮৭ হাজার ১২৫ হেক্টর মোট দুই লাখ এক হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আগাম ও নাবী জাতের সরিষা চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে দুই টন হিসেবে চার লাখ দুই হাজার ৪৬০ টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৪১ কোটি টাকা। চলনবিলের বুক চিরে ছুটে চলা বনপাড়া-হাটিকুমরুল যমুনা সেতু সংযোগ মহাসড়কের দু’ধারে মাঠের পর মাঠ দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। সেই হলুদ ছুঁয়েছে দিগন্তরেখায়। নয়নাভিরাম সেই সরিষা ক্ষেতের আলে আলে এখন শুধুই সারিসারি মৌবাক্স। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
চলনবিল শুধু মাছেই নয়; মধু উৎপাদনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিলাঞ্চল। এ অঞ্চলের ফসলের মাঠগুলোতে এখন সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ জুড়ে বিরাজ করছে থোকা থোকা হলুদ ফুলের দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মধু উৎপাদনে চলনবিলে এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকলে চলতি মওসুমে চলনবিল অঞ্চল থেকে প্রায় ২৫ লাখ কেজি (আড়াই হাজার টন) মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মৌচাষিরা আশা প্রকাশ করেছেন। প্রতি কেজি ৪০০ টাকা হিসেবে এর বাজার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। চলনবিলে প্রায় এক হাজার মৌচাষি মধু সংগ্রহে এসেছেন। আর এসব মৌচাষির সাথে শ্রমিক-কর্মচারি রয়েছেন আরো তিন-চার হাজার।
পাবনা-নাটোর ও সিরাজগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মওসুমে চলনবিলের ২৬ উপজেলায় এক লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীলসহ বিভিন্ন জাতের সরিষার চাষ হয়েছে। এ অঞ্চলে মৌচাষিরা মধু সংগ্রহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অন্যদিকে পরাগায়ন ভালো হওয়ায় সরিষার ফলনও বাড়ছে। প্রতিবছর অগ্রহায়ন-পৌষ-মাঘ মাসজুড়ে চলনবিলের মাঠগুলো সরিষা ফুলে ফুলে ভরে যায়।
এ সময় দেশের বিভিন্ন এলাকার মৌচাষিরা বিশাল চলনবিলের সরিষা ক্ষেতে আসেন মধু সংগ্রহের জন্য। এবছরও প্রায় এক হাজার মৌচাষি চলনবিল এলাকার সরিষা ক্ষেতে মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন। মৌমাছিরা সরিষার ফুলে ফুলে ছুটে মধু সংগ্রহ করে মৌবাক্সে ফিরে আসছে। এক সময়ের মৎস্যভান্ডার খ্যাত চলনবিল এখন যেন ‘মধু’র ভান্ডারে পরিনত হয়েছে।
চলনবিল পাড়ের আলাইপুর গ্রামের কৃষক সুশান্ত কুমার শান্ত বলেন, এবছর তিনি ৭৫ বিঘা জমিতে জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় সাত থেকে আট মণ সরিষা পাওয়ার আশা করছেন। সরিষা চাষে প্রতি বিঘায় ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা লাভ হবে। তিনিও মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন। চলনবিল পাড়ের দলগাসা গ্রামের কৃষক মনিরুজ্জামান বলেন, সরিষা চাষ খুবই লাভজনক। তিনি এবছর বারি-১৪ জাতের সরিষা চাষ করেছেন। তার ক্ষেতেও বসেছে মৌবাক্স। এতে সরিষার ফলন ভালো হওয়ার আশা করছেন তিনি।
চলনবিল অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কলমগ্রামের কৃষক রমজান আলী জানান, অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমান লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমান জমিতে সরিষা চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। এ অঞ্চলে সরষের আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মওসুমি মৌচাষিদের তৎপরতা। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
এছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকেরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। পাবনার হান্ডিয়াল এলাকার কৃষক আলেক দেওয়ান জানন, তিনি পাঁচ একর জমিতে সরিষা আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। ছয় বছর ধরে সরিষা চাষ করে তিনি প্রতি মওসুমে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভ করেছেন। চলতি মওসুমে আরো বেশি লাভের আশা করছেন।
খুলনা থেকে চলনবিলের কলম এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসা নাছির উদ্দিন বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে মধু আহরণ করছে। মাত্র কয়েক দিন হলো এখানে এসেছেন। গত বছর তিনি দুই টন মধু আহরণ করেছিলেন, এবার আবহাওয়া ভালো থাকলে তিন টনের বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। মৌচাষিরা জানান, বছরের সাত মাস মধু পাওয়া যায়। সরষের পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিলসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোঃ জামাল উদ্দিন বলেন, প্রতি বছর চলনবিল অঞ্চলের বির্স্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সরিষা আবাদ হয়ে থাকে। সরিষার ক্ষেতে মধুর বাক্স স্থাপনে মৌমাছি পরাগায়নে সহায়তা করে। এতে সরিষার ফলন বেড়ে যায়। চাষি ও মৌচাষি উভয়েই লাভবান হয়ে থাকেন। তিনি জানান, প্রতি বছর চলনবিল এলাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৌচাষিরা আসেন। তাদের সংগৃহীত মধু পাইকাররা কিনে বিভিন্ন কোম্পানিতে সরবরাহ করেন। এবার আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।
বাখ//এস