পাবনার বেড়ায় যমুনা নদীতে বিএনপি’র কিছু নেতাকর্মীর অবাধে বালু উত্তোলন

পাবনার বেড়া উপজেলায় কোন বালু মহাল নেই। তবু থেমে নেই বালু উত্তোলন। প্রতিরাতে যমুনা নদীর ১০টি পয়েন্টে থেকে প্রায় দুই লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে কার্গোতে রাজবাড়ীসহ ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে। নদীর ভূউপরিভাগে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন বসিয়ে ভূ-অভ্যন্তরের কাঠামো ভেঙ্গে তছনছ করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু ব্যবসা অধিক লাভজনক হওয়ায় এই অশুভ তৎপরতা কোন ক্রমেই বন্ধ হচ্ছে না। বালুদস্যুরা ড্রেজার, ভলগেট, বোমামেশিন নামে উচ্চশক্তি সম্পন্ন ইঞ্জিন বসিয়ে নদীর তলদেশের ২৫-৩০ ফুট গভীর থেকে বালু উত্তোলন করায় ভূস্তর ও নদীর বেড লেভেল (তলদেশ) এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হুমকীর মুখে পড়েছে জলজপ্রাণী ও জীববৈচিত্র।
এদিকে বেড়া উপজেলা প্রশাসনের একের পর এক অভিযানে কৌশল পাল্টেছে বালুদস্যুরা। তারা নগরবাড়ি নৌ-পুলিশ বড়কর্তাকে ম্যানেজ করে রাতে বালু করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বালু উত্তোলন ও বিক্রির শুন্যস্থান দখল করেছে স্থানীয় বিএনপি’র হরিরামপুরের রেজাউল মোল্লা, নয়ানপুরের মিজানুর রহমানসহ প্রায় ১৫ জন নেতাকর্মী। তারা শক্তিশালী বোমামেশিন ও ড্রেজারের সাহায্যে নদীর তলদেশের ২০-২৫ ফুট গভীর থেকে প্রতিরাতে দেড় থেকে দুই লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে কার্গোতে ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করে আসছে। প্রতিটি ড্রেজারের বালু উত্তোলন ক্ষমতা ৫০ থেকে ৭০ হাজার ঘনফুট। অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে নদী পাড়ের গ্রামগুলোর বাসতবাড়ী, ফসলী জমি, তীর সংরক্ষণ বাঁধ ও পুরাতন বণ্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ ভাঙনের হুমকীর মুখে পড়েছে।
ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান ও জেল জরিমানাতে থামছে না অবৈধভাবে বালু উত্তেলন ও বিক্রি। বিনা পুঁজিতে অধিক লাভ হওয়ায় প্রভাবশালী বালুদস্যুরা জেল জরিমানা উপেক্ষা করে নদী থেকে বালু উত্তোলনসহ প্রকাশ্যে বেচা-কেনা অব্যহত রেখেছে। বালুদস্যুরা প্রভাবশালী হওয়া নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বালুদস্যুরা কৌশল পাল্টে রাতে যমুনা নদীর পেঁচাকোলা, নটাখোলা, হরিরামপুর, কাজীরহাট, খানপুরাসহ ১০টি পয়েন্টে বোমামেশিন ও স্থানীয়ভাবে তৈরি শক্তিশালী ড্রেজারের ও ভলগেটের সাহায্যে নদীর স্রোতলদেশে থেকে লাখ লাখ ফুট বালু উত্তোলন করছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর তলদেশের ভূস্তর তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এতে নদীর তধারা গতিপথ পরিবর্তন করায় গত এক বছরে নদী ভাঙনে দেড় শতাধিক বসতবাড়ী, কবরস্থান, মসজিদ, মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ফসলী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
নটাখোলায় বালু উত্তোলনের ফলে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রীডের টাওয়ার ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কাজীরহাট ও নটাখোলা এলাকায় এই বালু উত্তোলন সাথে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত রয়েছে। কাজীরহাটের ভাটিতে পদ্মার পাড়ে ঢালারচর অবস্থিত। পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেল লাইন ও ঢালারচরে রেল ষ্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় নদী ষ্টেশনের দিকে সড়ে আসছে। ফলে নদী পাড়ের বাতবাড়ি ফসলী জমি ভাঙনের হুমকীর মুখে পড়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
যমুনা নদী পাড়ের কাজিরহাট, নটাখোলা, হরিরামপুর, বেড়া ডাকবাংলা, বৃশালিখায় বাঘাবাড়ীতে বড়াল নদীর দক্ষিণপাড়ে বালু বেচা-কেনার হাট বসেছে। বালুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে। বালু মজুতের বিভিন্ন পয়েন্টে থেকে প্রতিদিন দেড় শতাধিক ট্রাক বালু জেলার বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। বালু বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমান টাকা। এদিকে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নটাখোলা, কাজীরহাট ঘাট হয়ে ভাটিতে ঢালারচরে বারোকোদালিয়ায় যমুনা নদী থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমান বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সেখানে একাাধিক ভলগেট, ড্রেজার ও বোমামেশিনের সাহায্যে বালু উত্তোলন করে বড় বড় নৌকা অথবা কার্গোজাহাজ বোঝাই করে নগরবাড়ীর অদুরে নিয়ে আসা হচ্ছে। এর পর সেখান থেকে দীর্ঘ পাইপের মাধ্যমে উত্তোলিত বালু এনে রাখা হয় নগরবাড়ী ঘাটের পাশে খোলা জায়গায়। সেখান থেকে ট্রাক বোঝাই করে বালু বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। তবে কার্গোতেই বেশি বালু পাঠানো হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রশাসনের অভিযান পরিচালনার আগেই তারা খবর পেয়ে যায়, সাথে সাথে ড্রেজার মেশিন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। তারা জানান, মানভেদে প্রতিট্রাক বালু বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০টাকা থেকে দুই হাজার টাকা দরে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, নগরবাড়ি নৌপুলিশকে ম্যানেজ করে যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে প্রতিরাতে ১৫ থেকে ২০ কার্গোবালু রাজবাড়িসহ ভাটি অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে। তবে নগরবাড়ি নৌ-পুলিশ তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে।
বালু উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্তরে কাঠামোগত কতটা পরিবর্তণ হচ্ছে এই প্রশ্নে পাবনার পরিবেশবিদ মোঃ ফজলে রাব্বি বলেছেন, ভূগর্ভের সাজানো স্তর এখন আর নেই। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভূস্তরের কাঠামো ভেঙ্গে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এতে নদীর পানিতে কমে যাচ্ছে অক্্িরজেনের মাত্রা। জীববৈচিত্র ও জলজপ্রাণী হুমকীর মুখে পড়েছে। রিখটার স্কেলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে বহু এলাকা দেবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ জাহিদুল ইসলাম এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, ভাঙন প্রতিরক্ষা কাজের পাশ দিয়ে যমুনা নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদীর যে কোনো পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন প্রতিরক্ষা কাজের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। নদীর যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হয় তার চার পাশের এলাকা ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে জন্য প্রশাসনকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে তিনি জানিয়েছেন।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মোরশেদুল ইসলাম বলেন, থানা পুলিশ, নগরবাড়ি ও কাজীরহাট নৌপুলিশে সহায়তায় বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান আছে। তবে নৌপুলিশের জনবল সঙ্কটের কারণে রাতের বেলা অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।
বাখ//আর