০৪:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চলনবিলে গণহারে পুকুর খননে অস্তিত্ব সংকটে সেচ প্রকল্প

আশরাফুল ইসলাম রনি, তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি

সিরাজগঞ্জে গণহারে পুকুর খনন করায় আবাদি জমির অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে শতাধিক সেচ প্রকল্প। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব প্রকল্প থেকে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১৫ কোটি টাকা। কৃষি জমি পুকুর শ্রেণিতে পরিণত হওয়ায় ফসল উৎপাদনে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এই সংকট সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে জেলার চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলায়।

সূত্র জানায়, স্মরণাতীতকাল থেকে এ অঞ্চলের কৃষক ফসল ফলাতেন প্রাকৃতিক উৎস হতে প্রাপ্ত পানি ব্যবহার করে। গত শতাব্দীর ৮০ দশক থেকে নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় এবং এক ফসলি জমি দুই-তিন ফসলের আওতায় আনতে কৃষক নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। এ সময় তারা ডিজেলচালিত শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে কৃষিতে বিপ্লব আনেন। কিন্তু গণহারে ও অপরিকল্পিতভাবে মাত্রা অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় ৯০ দশকে পানির স্তর দ্রæত নিচে নামতে থাকে। পাশাপাশি ডিজেল চালিত সেচ ব্যবস্থা ব্যয় বহুল হওয়ায় কৃষক খুব একটা লাভের মুখ দেখতে না পাওয়ায়, সরকার বিপুল কৃষি ও অকৃষি জমি চাষযোগ্য ও লাভজনক করার লক্ষ্যে সমবায় ভিত্তিক বিদ্যুৎচালিত সেচ প্রকল্প হাতে নেয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএডিসির আওতায় পানাসি প্রকল্প ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিরাজগঞ্জ জেলায় স্থাপন করে বিদ্যুৎচালিত মোট ৫৯৭ টি গভীর নলকূপ। এ ছাড়াও শক্তিচালিত পাম্প স্থাপন করা হয় ১৩১৮টি ও ব্যক্তি পর্যায়ে অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয় ৩১৭৮টি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, এতে করে এক লাখ ৮২ হাজার ১০০ হেক্টর জমি চাষের আওতায় এসেছে। শস্য বহুমুখী করণের পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদি ও উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন জাত মাঠে নিয়ে আসায় উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। এক ফসলি অধিকাংশ জমি রূপান্তরিত হয় দুই-তিন ফসলে। এসব জমি থেকে উৎপাদিত ফসল জেলার চাহিদা মিটিয়ে বাইরে বিক্রি করা হয়।

কিন্তু গত এক দশকে জেলার তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলায় গণহারে পুকুর খনন করায় কমে গেছে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় আরো প্রায় ৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি জলাবদ্ধতায় অনাবাদি হয়ে পড়েছে। সেইসাথে গভীর নলকূপের সেচ প্রকল্পগুলো মাঝে পুকুর খনন করায় শতাধিক সেচ প্রকল্প অত্বিস্ত সংকটে পড়েছে। সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় এসব সেচ প্রকল্প থেকে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব, অপরদিকে উৎপাদনেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

ইতোমধ্যে ২০টি প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেসব প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে মর্মে পানাসি ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, উল্লাপাড়া উপজেলার বাঙ্গালা ইউনিয়নের বানিয়াখৈর মৌজায় পাশাপাশি রয়েছে বিএডিসি পানাসি প্রকল্পের তিনটি গভীর নলকূপ। এরমধ্যে স্থানীয় ভূমিগ্রাসী চক্র প্রায় ১০০ বিঘার একটি পুকুর খনন করে রীতিমতো মাছ চাষ করছে। পাশে আরেকটি দেড়শ বিঘার পুকুর খনন করার প্রস্তুতি চলছে। এ কাজে দুটি খনন যন্ত্র আনা হয়েছে। এতে করে তিনটি গভীর নলকূপের প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্থ হবে মর্মে অভিযোগ করেছেন একটি গভীর নলকূপের প্রকল্প ম্যানেজার খলিলুর রহমান।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে একটি মহল ক্ষমতার জোরে প্রকল্পের মাঝে ১০০ বিঘার পুকুর খনন করেছে। এতে করে এ সেচ প্রকল্পটি এখন বন্ধ হওয়ার পথে। এখন আবার স্থানীয় বিএনপির নেতারা সংঘবদ্ধ হয়ে আরো ১৫০ বিঘা সেচ প্রকল্পের জমিতে পুকুর খনন করার চেষ্টা করছেন। নিরুপায় কৃষক তাদের কৃষি জমি রক্ষা করতে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না।

একই চিত্র দেখা গেছে তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া, মঙ্গলবাড়িয়া, সান্তান, বাঁশবাড়িয়া, কাউরাইল, মাধাইনগর, ঝুরঝুরি, তাড়াশ পৌর সদর ও রায়গঞ্জ উপজেলার আমশড়া মাঠে বিএডিসির পানাসি ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রকল্পে।

বোয়ালিয়া গ্রামের সোলায়মান হোসেন অভিযোগ করে বলেন, আমাদের মাঠে আর কোনো আবাদি জমি অবশিষ্ট নেই। যার ফলে এখানকার দুটি সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু পুকুর আর জলাবদ্ধতা। একই অভিযোগ করেন মাধবপুর গ্রামের কৃষক মো মনসুর আলী।

বিএডিসির সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী চিত্ত রঞ্জন রায় ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পুকুর খননে অনেক সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে আমরা অন্যত্র পুনঃস্থাপন করে আবারও প্রকল্পগুলো সচল করার চেষ্টা করছি। এতে করে সরকারের আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আ: জা: মু: আহসান শহীদ সরকার বলেন, গণহারে পুকুর খনন করায় কৃষি জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উচ্চ ফলনশীল জাত মাঠে থাকায় এখনো লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা হলেও ঠিক রাখা যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় জনসচেতনতা। তা নাহলে কৃষিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে।

বাখ//আর

শেয়ার করুন

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আপডেট : ০৬:৩৬:৪৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫
৯২ জন দেখেছেন

চলনবিলে গণহারে পুকুর খননে অস্তিত্ব সংকটে সেচ প্রকল্প

আপডেট : ০৬:৩৬:৪৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫

সিরাজগঞ্জে গণহারে পুকুর খনন করায় আবাদি জমির অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে শতাধিক সেচ প্রকল্প। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব প্রকল্প থেকে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১৫ কোটি টাকা। কৃষি জমি পুকুর শ্রেণিতে পরিণত হওয়ায় ফসল উৎপাদনে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এই সংকট সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে জেলার চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলায়।

সূত্র জানায়, স্মরণাতীতকাল থেকে এ অঞ্চলের কৃষক ফসল ফলাতেন প্রাকৃতিক উৎস হতে প্রাপ্ত পানি ব্যবহার করে। গত শতাব্দীর ৮০ দশক থেকে নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় এবং এক ফসলি জমি দুই-তিন ফসলের আওতায় আনতে কৃষক নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। এ সময় তারা ডিজেলচালিত শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে কৃষিতে বিপ্লব আনেন। কিন্তু গণহারে ও অপরিকল্পিতভাবে মাত্রা অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় ৯০ দশকে পানির স্তর দ্রæত নিচে নামতে থাকে। পাশাপাশি ডিজেল চালিত সেচ ব্যবস্থা ব্যয় বহুল হওয়ায় কৃষক খুব একটা লাভের মুখ দেখতে না পাওয়ায়, সরকার বিপুল কৃষি ও অকৃষি জমি চাষযোগ্য ও লাভজনক করার লক্ষ্যে সমবায় ভিত্তিক বিদ্যুৎচালিত সেচ প্রকল্প হাতে নেয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএডিসির আওতায় পানাসি প্রকল্প ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিরাজগঞ্জ জেলায় স্থাপন করে বিদ্যুৎচালিত মোট ৫৯৭ টি গভীর নলকূপ। এ ছাড়াও শক্তিচালিত পাম্প স্থাপন করা হয় ১৩১৮টি ও ব্যক্তি পর্যায়ে অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয় ৩১৭৮টি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, এতে করে এক লাখ ৮২ হাজার ১০০ হেক্টর জমি চাষের আওতায় এসেছে। শস্য বহুমুখী করণের পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদি ও উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন জাত মাঠে নিয়ে আসায় উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। এক ফসলি অধিকাংশ জমি রূপান্তরিত হয় দুই-তিন ফসলে। এসব জমি থেকে উৎপাদিত ফসল জেলার চাহিদা মিটিয়ে বাইরে বিক্রি করা হয়।

কিন্তু গত এক দশকে জেলার তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলায় গণহারে পুকুর খনন করায় কমে গেছে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় আরো প্রায় ৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি জলাবদ্ধতায় অনাবাদি হয়ে পড়েছে। সেইসাথে গভীর নলকূপের সেচ প্রকল্পগুলো মাঝে পুকুর খনন করায় শতাধিক সেচ প্রকল্প অত্বিস্ত সংকটে পড়েছে। সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় এসব সেচ প্রকল্প থেকে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব, অপরদিকে উৎপাদনেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

ইতোমধ্যে ২০টি প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেসব প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে মর্মে পানাসি ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, উল্লাপাড়া উপজেলার বাঙ্গালা ইউনিয়নের বানিয়াখৈর মৌজায় পাশাপাশি রয়েছে বিএডিসি পানাসি প্রকল্পের তিনটি গভীর নলকূপ। এরমধ্যে স্থানীয় ভূমিগ্রাসী চক্র প্রায় ১০০ বিঘার একটি পুকুর খনন করে রীতিমতো মাছ চাষ করছে। পাশে আরেকটি দেড়শ বিঘার পুকুর খনন করার প্রস্তুতি চলছে। এ কাজে দুটি খনন যন্ত্র আনা হয়েছে। এতে করে তিনটি গভীর নলকূপের প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্থ হবে মর্মে অভিযোগ করেছেন একটি গভীর নলকূপের প্রকল্প ম্যানেজার খলিলুর রহমান।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে একটি মহল ক্ষমতার জোরে প্রকল্পের মাঝে ১০০ বিঘার পুকুর খনন করেছে। এতে করে এ সেচ প্রকল্পটি এখন বন্ধ হওয়ার পথে। এখন আবার স্থানীয় বিএনপির নেতারা সংঘবদ্ধ হয়ে আরো ১৫০ বিঘা সেচ প্রকল্পের জমিতে পুকুর খনন করার চেষ্টা করছেন। নিরুপায় কৃষক তাদের কৃষি জমি রক্ষা করতে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না।

একই চিত্র দেখা গেছে তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া, মঙ্গলবাড়িয়া, সান্তান, বাঁশবাড়িয়া, কাউরাইল, মাধাইনগর, ঝুরঝুরি, তাড়াশ পৌর সদর ও রায়গঞ্জ উপজেলার আমশড়া মাঠে বিএডিসির পানাসি ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রকল্পে।

বোয়ালিয়া গ্রামের সোলায়মান হোসেন অভিযোগ করে বলেন, আমাদের মাঠে আর কোনো আবাদি জমি অবশিষ্ট নেই। যার ফলে এখানকার দুটি সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু পুকুর আর জলাবদ্ধতা। একই অভিযোগ করেন মাধবপুর গ্রামের কৃষক মো মনসুর আলী।

বিএডিসির সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী চিত্ত রঞ্জন রায় ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পুকুর খননে অনেক সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে আমরা অন্যত্র পুনঃস্থাপন করে আবারও প্রকল্পগুলো সচল করার চেষ্টা করছি। এতে করে সরকারের আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আ: জা: মু: আহসান শহীদ সরকার বলেন, গণহারে পুকুর খনন করায় কৃষি জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উচ্চ ফলনশীল জাত মাঠে থাকায় এখনো লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা হলেও ঠিক রাখা যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় জনসচেতনতা। তা নাহলে কৃষিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে।

বাখ//আর