বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে
টঙ্গীর তুরাগ তীরে বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত, প্রথম দিনে তিন মুসুল্লীর মৃত্যু

টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে পাঁচ লক্ষাধিক মুসুল্লীর অংশগ্রহনে দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোর থেকেই ইজতেমা ময়দানে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি তুরাগ তীরে মূল প্যান্ডেলে এসে অবস্থান নিয়েছেন। ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হকের আম আম বয়ানের (উর্দুতে) মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। তার বয়ান বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে শোনান বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান।
শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে জুমার খুতবা শুরু হয়ে নামাজ শেষ হয় ১টা ৫৬ মিনিটে। বাংলাদেশের মাওলানা হাফেজ মোহাম্মদ জোবায়ের জুমার নামাজে ইমামতি করেন।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় গাজীপুরের টঙ্গী তুরাগতীরে ভোর থেকেই রাজধানীসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। ভোর থেকেই ইজতেমার বৃহত্তম জুমার নামাজে অংশ নিতে মানুষের ঢল নামে। দুপুর ১২টার দিকে মাঠ উপচে আশপাশের খোলা জায়গা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মূল ময়দানে জায়গা না পেয়ে আশপাশের বিভিন্ন সড়ক, ফুটপাত ও খালি জায়গায় অবস্থান নিয়ে নামাজ আদায় করেন হাজার হাজার মুসল্লি। অনেকেই বাড়ির ছাদ, নৌকা, গাড়ির ছাদে পাটি, পলিথিন, চট ও পত্রিকা বিছিয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন। এছাড়া টঙ্গীর বিভিন্ন উঁচু ভবনের ছাদ থেকেও মুসল্লিরা জুমার নামাজে শরিক হন। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তাবলিগ জামাতের মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, এবার বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে ৭২টি দেশের প্রায় দুই হাজার ১৫০ জন বিদেশি মুসল্লি এসেছেন। আরও বিদেশি মুসল্লি ইজতেমায় যোগ দেবেন বলে আশা করছেন আয়োজকরা।
বৃহত্তম জুমার নামাজে অংশ নিতে ঢাকা-গাজীপুরসহ আশপাশের জেলা থেকে মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানের দিকে আসতে শুরু করেছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথসহ সব পথেই মুসল্লিদের কাফেলা টঙ্গীর দিকে ছুটছে। জুমার নামাজে লাখ লাখ মুসল্লি শরিক হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বিরা জানায়, প্রতি বছর গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে তাবলীগ জামাত বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করেন। বিশ্ব ইজতেমায় বয়ান করেন বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় সব মাওলানারা। এতে বিভিন্ন বয়সের মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করেন। মুসলিম উম্মার দ্বিতীয় বৃহৎ সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা। প্র্রতিবছর ইজতেমার সময় শুক্রবার দেশের সর্ববৃহৎ জুমার নামাজ এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। সকাল পৌনে ১০টা থেকে খিত্তায় খিত্তায় তালিম শুরু হয়। তালিমের আগে মোজাকেরা (আলোচনা) করেন ভারতের মাওলানা জামাল। সকাল ১০টায় শিক্ষকদের উদ্দেশে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ফারাহিম সাহেব। ছাত্রদের নিয়ে বয়ান করেন প্রফেসর আব্দুল মান্নান (আলিগড়)। মসজিদে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আকবর শরিফ।
তাবলিগ জামাতের শুরায়ী নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ্ রায়হান জানান, বাদ জুম্মা উর্দুতে বয়ান করেন জর্ডানের শেখ উমর খতিব। বাদ আসর বয়ান করবেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের সাহেব এবং বাদ মাগরিব বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা আহমেদ লাট। বাদ আসর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের, বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আহমেদ লাট।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপির) গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য জানা যায়, ৪৬টি দেশের বিদেশি মুসল্লি এবারের প্রথম পর্বের ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে উর্দু ৭৬০ জন, আরব ৮৯ জন ও ইংলিশ ৩০৫ জন। আগে থেকেই বাংলাদেশে থেকে অবস্থানরত বিদেশি মেহমান ৪২৬ জনসহ মোট ১৫৮০ জন চারটি বিদেশি টেন্টে অবস্থান করছেন।
এ পর্যন্ত তিনজন মুসল্লীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ঠাকুরগাঁও জেলার বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম (৪০), খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ডুমুরিয়া বাজার এলাকার লোকমান হোসেন গাজীর ছেলে আব্দুল কুদ্দুস গাজী (৬০) এবং শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার ৩নং রাণী শিমুল গ্রামের সব্দুল্লাহর ছেলে সাবেদ আলী (৭০) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। তাদের মধ্যে আব্দুল কুদ্দুস গাজী ইজতেমা ময়দানে এবং বাকী দুইজন হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য রোগ এখন পর্যন্ত ৩৮ জন মুসল্লী টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে যার যার খিত্তায় চলে যায়। এদের মধ্যে একজন বিদেশি, ৫ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। মুসাব্বির (কং/১৪০৩) নামে একজন পুলিশ সদস্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মাওলানা সাদ অনুসারী ৮৫ জন বিদেশিসহ ২২০/২৫০ জন জুম্মার নামাজ আদায় করছেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপির) কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান জানান, ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশ ও র্যাবের কন্ট্রোল রুম এবং ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। মনিটরিং করা হচ্ছে সিসি ক্যামেরা মাধ্যমে। খিত্তায় খিত্তায় সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়া ইজতেমার নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে প্রায় ১০ হাজার।
তিনি আরো জানান, ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশ ও র্যাবের কন্ট্রোল রুম এবং ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। মনিটরিং করা হচ্ছে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে। খিত্তায় খিত্তায় সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। ইজতেমা আয়োজক কমিটির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রায় ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে।
তাবলিগের শুরায়ে নেজামি (জুবায়ের অনুসারী) ইজতেমার প্রথম পর্ব আয়োজন করছে। দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এই পর্ব। ৪১ জেলার মুসল্লি নিয়ে প্রথম ধাপ শেষ হবে ২ ফেব্রæয়ারি এবং ২৩ জেলার মুসল্লি নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমা শেষ হবে ৫ ফেব্রæয়ারি। এরপর ১৪ ফেব্রæয়ারি থেকে মাওলানা সাদপন্থিদের তিনদিনের ইজতেমা হওয়ার কথা রয়েছে।
ইজতেমার মুরুব্বিদের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৪৬ সালে কাকরাইল মসজিদে প্রথম ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে স্থানান্তর করা হয় ইজতেমা। পরে ১৯৭২ সালে সরকারিভাবে তুরাগ তীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।