০৮:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বানারীপাড়ায় মাসব্যাপি ২৩০ তম ঐতিহ্যবাহী সূর্যমণি মেলা শুরু

রাহাদ সুমন, বানারীপাড়া (বরিশাল) প্রতিনিধি

বরিশালের বানারীপাড়ায় মাসব্যাপি ২৩০ তম ঐতিহ্যবাহী সূর্যমণি মেলা শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১ টায় উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের বেতাল গ্রামে প্রয়াত খবির উদ্দিন মোল্লার বিশাল মাঠে সূর্যদেবের পুজার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ মেলার শুরু হয়। মেলা প্রাঙ্গনে মন্দিরে সূর্যদেবের পূজা অর্চনার নেতৃত্ব দেন পুজারী কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্য। আবহমান গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখতে সূর্যপুজা উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর মাঘ মাসের মাঘী পূর্ণিমার শুক্লা তিথিতে সূর্যপুজার মধ্য দিয়ে মাস ব্যাপী এ সূর্যমণি মেলার আয়োজন করে থাকেন।

কথিত আছে সূর্য দেবের পুজা উপলক্ষে নিজস্ব ভূমিতে বেতাল গ্রামের গঙ্গু সরকারের পূর্ব পুরুষরা এ মেলার আয়োজন করতেন। একদিন থেকে সপ্তাহ,সপ্তাহ থেকে পাক্ষিক পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে মাস ব্যপী সূর্যমণির মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। মেলার ইতিহাস জানতে গিয়ে জানা যায়,সরকার পরিবার মেলার স্থানের জমিতে ধান চাষের জন্য চাষ করাচ্ছিলেন। চাষিরা লাঙ্গল চালানোর সময় বর্তমানে মেলার মাঠের যে স্থানে মন্দির রয়েছে সেখানে ফলা আটকে যায়। কিছুতেই চাষিরা লাঙ্গলের সেই ফলা সামনে অগ্রসর করতে পারছিলেন না।

এমন খবর সরকার বাড়িতে গিয়ে জানান চাষিরা। এ খবরে গঙ্গু সরকারের মা দেবী মালা সরকার তাদের পাইক-প্যাদা নিয়ে ওই স্থানে উপস্থিত হন। যেখানে ফলা আটকে গিয়েছিলে সেখানটা ৪/৫ জন চাষি মিলে পুনরায় খুঁড়তে থাকেন। ওই সময় ফলার মাঝ বরাবরে একটি সূর্যাকৃতির মূল্যমান কষ্টি পাথরের মূর্তি পাওয়া যায়। দিনটি ছিলো মাঘী পূর্ণিমার শুক্লা তিথি।

ওই সময় একটি কাঠের ঘর তুলে মূর্তিটি সেখানে রক্ষিত রাখা হয় এবং সূর্যদেবের পূজার মধ্য দিয়ে একদিনের মেলার আয়োজন করেন সরকার পরিবার। সেই থেকেই প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমার শুক্লা তিথিতে মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। এভাবে আয়োজনের এক পর্যায়ে গঙ্গু সরকার পরিবার বেতাল গ্রামের তাদের পৈত্রিক বাড়িসহ যাতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি প্রতিবেশী মোল্লা পরিবারের কাছে বিক্রি করে ভারতে চলে যান।

তবে সরকার পরিবারের কয়েকটি শর্ত ছিলো জমি লিখে দেয়ার সময়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো প্রতি বছর যে স্থানে মেলা আয়োজন হয় সেখানে সূর্যদেবের পাকা মন্দির তৈরি করতে দেয়া, মেলা আয়োজনে সহযোগীতা করা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন, সরকার বাড়ির প্রতিবেশি ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যদের দিয়ে সূর্যদেবের পূজা-অর্চনা করানো,অত্রঅঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে থাকা প্রভৃতি। পরবর্তীতে মোল্লা পরিবারের সহযোগীতায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পর্যায়ক্রমে মেলার আয়োজন করে আসছেন।

এ বছর মেলায় রয়েছে দি রয়েল বেঙ্গল লক্ষণ দাস সার্কাস, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য যাত্রাপালা,মনোমুগ্ধকর পুতুল নাচ, আকষর্নীয় র‌্যাফেল ড্র, নাগরদোলা, নৌকার দোলা, ভূতের বাড়ি, জাম্পিং রাউন্ড, বাঘ-হাতি-ঘোড়ার চক্কর প্রভৃতি। এছাড়াও লোভনীয় নানা ধরণের মিষ্টি, বাহারী মজাদার ফুসকা, সুস্বাদু নানা খাবারের রেস্টুরেন্ট, কসমেটিকস, শিশুদের খেলনা,বাহারী তৈরী পোষাক, বেত ও বাঁশের তৈজসপত্র,কাঠের ফার্নিচার,নানা ধরণের ফল,মাটি ও স্টীলের তৈরি বিভিন্ন সাংসারিক প্রয়োজনীয় মলামালের কয়েকশত স্টল গড়ে তোলা হয়েছে।

এদিকে প্রাণের এ মেলাকে কেন্দ্র করে বানারীপাড়াসহ পাশর্^বর্তী বেশ কয়েকটি উপজেলা এবং জেলার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। এ মেলাকে কেন্দ্র করে পুরো বছর মাটি বা প্লাস্টিকের ব্যাংকে পয়সা জমায় শিশু-কিশোর,যুবক থেকে শুরু করে গৃহবধুরা। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাজার হাজার দর্শনার্থীতে সরগরম থাকে মেলা প্রাঙ্গন।

মেলা দেখতে বানারীপাড়ার প্রায় ঘরে ঘরে দূর দূরান্তের অতিথিরাও আসতে শুরু করেছেন। এ প্রসঙ্গে মেলা কমিটির সভাপতি ভক্ত কর্মকার বলেন, আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ করে মঙ্গলবার সকালে সূর্যদেবের পূজা-অর্চনার মধ্যদিয়ে মাসব্যাপি ২৩০ তম ঐতিহ্যবাহী সূর্যমণির মেলা শুরু হয়েছে। প্রাণের এ মেলা দেশের বিভিন্ন এলাকার ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের সকল মানুষের উৎসব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক মিলন মেলায় রূপ নেবে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তায় প্রশাসনের পাশাপাশি মেলা কমিটির নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালণ করবেন।

বাখ//এস

শেয়ার করুন

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আপডেট : ০৯:৫১:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
৭৪ জন দেখেছেন

বানারীপাড়ায় মাসব্যাপি ২৩০ তম ঐতিহ্যবাহী সূর্যমণি মেলা শুরু

আপডেট : ০৯:৫১:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বরিশালের বানারীপাড়ায় মাসব্যাপি ২৩০ তম ঐতিহ্যবাহী সূর্যমণি মেলা শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১ টায় উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের বেতাল গ্রামে প্রয়াত খবির উদ্দিন মোল্লার বিশাল মাঠে সূর্যদেবের পুজার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ মেলার শুরু হয়। মেলা প্রাঙ্গনে মন্দিরে সূর্যদেবের পূজা অর্চনার নেতৃত্ব দেন পুজারী কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্য। আবহমান গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখতে সূর্যপুজা উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর মাঘ মাসের মাঘী পূর্ণিমার শুক্লা তিথিতে সূর্যপুজার মধ্য দিয়ে মাস ব্যাপী এ সূর্যমণি মেলার আয়োজন করে থাকেন।

কথিত আছে সূর্য দেবের পুজা উপলক্ষে নিজস্ব ভূমিতে বেতাল গ্রামের গঙ্গু সরকারের পূর্ব পুরুষরা এ মেলার আয়োজন করতেন। একদিন থেকে সপ্তাহ,সপ্তাহ থেকে পাক্ষিক পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে মাস ব্যপী সূর্যমণির মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। মেলার ইতিহাস জানতে গিয়ে জানা যায়,সরকার পরিবার মেলার স্থানের জমিতে ধান চাষের জন্য চাষ করাচ্ছিলেন। চাষিরা লাঙ্গল চালানোর সময় বর্তমানে মেলার মাঠের যে স্থানে মন্দির রয়েছে সেখানে ফলা আটকে যায়। কিছুতেই চাষিরা লাঙ্গলের সেই ফলা সামনে অগ্রসর করতে পারছিলেন না।

এমন খবর সরকার বাড়িতে গিয়ে জানান চাষিরা। এ খবরে গঙ্গু সরকারের মা দেবী মালা সরকার তাদের পাইক-প্যাদা নিয়ে ওই স্থানে উপস্থিত হন। যেখানে ফলা আটকে গিয়েছিলে সেখানটা ৪/৫ জন চাষি মিলে পুনরায় খুঁড়তে থাকেন। ওই সময় ফলার মাঝ বরাবরে একটি সূর্যাকৃতির মূল্যমান কষ্টি পাথরের মূর্তি পাওয়া যায়। দিনটি ছিলো মাঘী পূর্ণিমার শুক্লা তিথি।

ওই সময় একটি কাঠের ঘর তুলে মূর্তিটি সেখানে রক্ষিত রাখা হয় এবং সূর্যদেবের পূজার মধ্য দিয়ে একদিনের মেলার আয়োজন করেন সরকার পরিবার। সেই থেকেই প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমার শুক্লা তিথিতে মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। এভাবে আয়োজনের এক পর্যায়ে গঙ্গু সরকার পরিবার বেতাল গ্রামের তাদের পৈত্রিক বাড়িসহ যাতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি প্রতিবেশী মোল্লা পরিবারের কাছে বিক্রি করে ভারতে চলে যান।

তবে সরকার পরিবারের কয়েকটি শর্ত ছিলো জমি লিখে দেয়ার সময়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো প্রতি বছর যে স্থানে মেলা আয়োজন হয় সেখানে সূর্যদেবের পাকা মন্দির তৈরি করতে দেয়া, মেলা আয়োজনে সহযোগীতা করা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন, সরকার বাড়ির প্রতিবেশি ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যদের দিয়ে সূর্যদেবের পূজা-অর্চনা করানো,অত্রঅঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে থাকা প্রভৃতি। পরবর্তীতে মোল্লা পরিবারের সহযোগীতায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পর্যায়ক্রমে মেলার আয়োজন করে আসছেন।

এ বছর মেলায় রয়েছে দি রয়েল বেঙ্গল লক্ষণ দাস সার্কাস, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য যাত্রাপালা,মনোমুগ্ধকর পুতুল নাচ, আকষর্নীয় র‌্যাফেল ড্র, নাগরদোলা, নৌকার দোলা, ভূতের বাড়ি, জাম্পিং রাউন্ড, বাঘ-হাতি-ঘোড়ার চক্কর প্রভৃতি। এছাড়াও লোভনীয় নানা ধরণের মিষ্টি, বাহারী মজাদার ফুসকা, সুস্বাদু নানা খাবারের রেস্টুরেন্ট, কসমেটিকস, শিশুদের খেলনা,বাহারী তৈরী পোষাক, বেত ও বাঁশের তৈজসপত্র,কাঠের ফার্নিচার,নানা ধরণের ফল,মাটি ও স্টীলের তৈরি বিভিন্ন সাংসারিক প্রয়োজনীয় মলামালের কয়েকশত স্টল গড়ে তোলা হয়েছে।

এদিকে প্রাণের এ মেলাকে কেন্দ্র করে বানারীপাড়াসহ পাশর্^বর্তী বেশ কয়েকটি উপজেলা এবং জেলার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। এ মেলাকে কেন্দ্র করে পুরো বছর মাটি বা প্লাস্টিকের ব্যাংকে পয়সা জমায় শিশু-কিশোর,যুবক থেকে শুরু করে গৃহবধুরা। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাজার হাজার দর্শনার্থীতে সরগরম থাকে মেলা প্রাঙ্গন।

মেলা দেখতে বানারীপাড়ার প্রায় ঘরে ঘরে দূর দূরান্তের অতিথিরাও আসতে শুরু করেছেন। এ প্রসঙ্গে মেলা কমিটির সভাপতি ভক্ত কর্মকার বলেন, আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ করে মঙ্গলবার সকালে সূর্যদেবের পূজা-অর্চনার মধ্যদিয়ে মাসব্যাপি ২৩০ তম ঐতিহ্যবাহী সূর্যমণির মেলা শুরু হয়েছে। প্রাণের এ মেলা দেশের বিভিন্ন এলাকার ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের সকল মানুষের উৎসব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক মিলন মেলায় রূপ নেবে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তায় প্রশাসনের পাশাপাশি মেলা কমিটির নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালণ করবেন।

বাখ//এস