চলতি বোরো মওসুমে ১৯ জেলায় ডিজেলের চাহিদা ৩৭ কোটি লিটার

চলতি বোরো মওসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ ১৯ জেলায় ছয় লাখ ৯০ হাজার ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র চালাতে অতিরিক্ত প্রায় ৩৭ কোটি লিটার ডিজেল প্রয়োজন। বিপিসি’র বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি কোম্পানির বিপণন কেন্দ্রে আপৎকালীন মজুদ আছে সাড়ে চার কোটি লিটার। আরো দেড় কোটি লিটার ডিজেলবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ি ডিপোর পথে রয়েছে বলে বিপিসি’র একটি সূত্রে জানা গেছে।
সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী নৌবন্দর ট্রানজিট বাফারগুদাম থেকে সড়ক পথে উত্তরাঞ্চলের ১৪টি বাফার গুদামে মজুদের জন্য রাসায়নিক সার পাঠানো হয়। কিন্তু নাব্যতা সঙ্কটে কার্গোজাহাজ পূর্ণ লোড নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে আসতে পারছে না। অর্ধেক সার লোড নিয়ে সেগুলো বন্দরে আসছে। ফলে বাফার গুদামগুলোতে সময়মতো সার পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিসিআইসি’র বাঘাবাড়ী বাফার গুদাম ইনচার্জ আব্দুল্লা আল আনছারী।
উত্তরাঞ্চলে সর্ববৃহৎ নৌবন্দর বাঘাবাড়ীর সাথে যোগাযোগের একমাত্র নৌপথ যমুনা নদীর ১২টি পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট রয়েছে। নদীতে বালুর প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নদীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর ও ডুবোচর। ফলে বাঘাবাড়ী বন্দরমুখী রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী ভ্যাসেল মাঝে মধ্যেই ডুবোচরে আটকা পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাঘাবাড়ী বন্দরমুখী রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এতে বোরো আবাদে সার ও জ্বালানী তেলের সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বাঘাবাড়ী বন্দর সূত্রে জানা যায়, রাসায়নিক সার, ক্লিংকার ও পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচলের জন্য ১১ থেকে ১২ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন হয়, অথচ নৌবন্দরের প্রায় ৮ কিলোমিটার ভাটিতে বেড়ার নাকালিয়া থেকে আরিচা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার এলাকার পেঁচাকোলা, রাকশা, সাফুল্লাসহ ১২টি পয়েন্টে পানির গভীরতা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭ থেকে ৮ ফুটে।
রাজশাহী ও রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এবং বিপিসি’র বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপো সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মওসুমে সেচের জন্য ফেব্রæয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল এই তিন মাসে ১৯ জেলায় প্রায় ৩৭ কোটি লিটার ডিজেল প্রয়োজন হয়। এ অঞ্চলের ছয় লাখ ৯০ হাজার ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র চালাতে গড়ে প্রতিদিন ৪১ লাখ লিটার ডিজেল প্রয়োজন হয়। এরমধ্যে বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপোর তিনটি কোম্পানির বিপণন কেন্দ্র থেকে ৩০ লাখ লিটার, পার্বতীপুর, রংপুর, নাটোর ও রাজশাহী ডিপো থেকে প্রায় ১১ লাখ লিটার ডিজেল সরবরাহ করা হচ্ছে। ১৯ জেলায় জ্বালানী তেল চাহিদার ৬০ ভাগই সরবরাহ করা হয় বাঘাবাড়ী ডিপো থেকে।
বিআইডাব্লিউটিসির আরিচা ঘাটের ম্যানেজার আবু আব্দুল্লাহ বলেন, রাসায়নিক সার ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য ১০ থেকে ১১ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে এ নৌপথে কোথাও কোথাও ৭ থেকে ৮ ফুট পানির গভীরতা রয়েছে। প্রতিদিনই নদীতে পানি কমছে। বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে আরিচা পর্যন্ত নৌপথের হরিরামপুর, চরসাফুল্লা, নাকালিয়া, পেঁচাকোলা, নাকালী, নগড়বাড়ীসহ ডজনখানেক পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে হরিরামপুর, চরসাফুল্লা ও নগড়বাড়ী পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে মোহগঞ্জ, হরিরামপুর, ও নাকালী পয়েন্টে ডুবোচরে পণ্যবাহী জাহাজ মাঝে মধ্যে আটকে পড়ছে। এ অবস্থায় গত নভেম্বরে বিআইডাব্লিউটিসির দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌপথকে আশঙ্কাজনক ঘোষনা দিয়ে সাড়ে ছয় ফুট ড্রাফটের বেশি গভীরতার কার্গো জাহাজকে ওই পথে চলাচল না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে।
বাঘাবাড়ী নৌবন্দর নিয়ন্ত্রন কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌপথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ ১৯ জেলায় জ্বালানী তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাধ্যম। এ নৌপথে জ্বালানী তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপো থেকে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী টাংগাইল, ময়মনসিং ও জামালপুর জেলায় চাহিদার ৬০ ভাগ, পার্বতীপুর, রংপুর, নাটোর ও রাজশাহী ডিপো থেকে ৪০ ভাগ জ্বলানী তেল সরবরাহ করা হয়। রাসায়নিক সার চাহিদার শতভাগ বাঘাবাড়ি থেকে উত্তরাঞ্চলের ১৪টি বাফারগুদামে সরবরাহ করা হয়। আবার এ অঞ্চল থেকে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের মাধ্যমে চাল ও গমসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। নাব্যতা সঙ্কটে বন্দরে আমদানি রফতানি অনেক কমে গেছে। বিআইডাবিøউটিএ নৌ চ্যানেলের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য ৪টি ড্রেজার দিয়ে ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদী বিশেষজ্ঞ কামরুন নাহার বলেন, ভারত থেকে আসা ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তা নদীর প্রবাহ একসঙ্গে ধারন করে যমুনা নদী বিশাল জলরাশি নিয়ে বির্স্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান ছিল। কিন্তু ভারত তিস্তা ও ব্রক্ষপুত্রে নদে বহুসংখ্যক জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণ করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করছে। এতে সেচ মওসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ কমে ২০০ কিউসেকে দাঁড়িয়েছে। ফলে যমুনা নদীতে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদে পানি প্রবাহ না বাড়লে যমুনায় নাব্যতা সঙ্কট কমার কোন সম্ভাবনা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বিআইডাব্লিউটিসির ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, এ নৌপথে একদিকে পানির স্তর কমছে, অন্য দিকে বালুর প্রবাহ বেড়েছে। ফলে নদীর তলদেশের বিভিন্ন স্থানে বালু জমে ডুবোচরের সৃষ্টি হচ্ছে। নৌপথ সচল রাখতে বিআইডাব্লিউটিসির ড্রেজার দিয়ে যেখানে প্রয়োজন সেখানে ড্রেজিং করা হবে। কখন কোন পয়েন্টে এ অবস্থার সৃষ্টি হবে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। নদীতে বালির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া যেখানে চরের সৃষ্টি হবে সেখানেই ড্রেজিং করা হবে। যমুনা নদীর তলদেশ অস্থিতিশীল হওয়ায় বালু জমে এ নৌপথের বিভিন্ন পয়েন্টে আকস্মিক ডুবোচরের সৃষ্টি হচ্ছে।
বিপিসি’র বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপোর নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, বাঘাবাড়ীতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল কোম্পানির ডিপোতে সাড়ে ৪ কোটি লিটার ডিজেল মজুদ আছে। প্রতিদিন একাধিক জাহাজ জ্বালানী তেল নিয়ে বন্দর ডিপোতে ভিড়ছে। জ্বালানী তেল বিশেষ করে ডিজেল সঙ্কটের কোন আশঙ্কা নেই বলে সূত্রটি জানিয়েছে।
বাখ//এস