০১:৫০ অপরাহ্ন, রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শফিকুল হক চৌধুরী : মানবতার এক নিঃশব্দ বিপ্লবী

মো: খাদেমুল ইসলাম, দিনাজপুর প্রতিনিধি

কেউ স্বপ্ন দেখে, কেউ স্বপ্ন দেখায়, আর কেউ সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে। এটাই নিয়তির নিয়ম। তবে মাঝে মাঝে নিয়তির গণ্ডি ভেঙে কিছু মানুষ এমন এক অধ্যায় রচনা করে, যা সময়ের ক্যানভাসে অমর চিত্র হয়ে থাকে। কেউ হাসায়, কেউ কাঁদায়। কেউ নিজে হাসে, কেউ চোখের জলে ভাসে। আর এর মাঝেই উদিত হয় ব্যতিক্রমী কিছু চরিত্র—রহস্যময়, অভূতপূর্ব, অনন্য।

তেমনি এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের নাম শফিকুল হক চৌধুরী।
তাঁর প্রথম দার্শনিক শিক্ষা ছিল—
“নিয়মের ক্ষেত্রে কঠোর হও, কিন্তু আচরণে হও কোমল।”
“জিহ্বা দিয়ে আঘাত করো না, বরং ভালোবাসার আলিঙ্গনে তোমার উদ্দেশ্য পূরণ করো।”

তিনি শুধু একজন সংগঠক বা নেতা ছিলেন না, ছিলেন এক দার্শনিক, কর্মযোগী এবং নিঃশব্দ বিপ্লবের কারিগর। আজ, তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই মহৎ আত্মাকে, যিনি শুধু নেতৃত্ব দেননি, একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছেন।

কিছু মানুষের পদচিহ্ন এত গভীর হয় যে, সময়ের প্রবাহও তাকে মুছে ফেলতে পারে না। শফিকুল হক চৌধুরী (১৯৪৯-২০২১) ছিলেন তেমনই একজন—একজন যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছিলেন সেইসব মানুষের জন্য, যাদের জন্য সমাজের মূলধারায় স্থান ছিল না।

তিনি জন্মেছিলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের এক ছোট্ট গ্রামে। চাইলে তিনি সহজেই ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির পথে হাঁটতে পারতেন। কিন্তু তিনি এক ভিন্ন পথ বেছে নিলেন—সেবার পথ, ত্যাগের পথ, এক নিঃশব্দ বিপ্লবের পথ। বিসিএস ক্যাডার হিসেবে প্রশিক্ষণ পেলেও, সরকারি চাকরির মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরং, ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আশা’ (ASA), যা হয়ে উঠল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের আলোকবর্তিকা।
যারা দারিদ্র্যের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছিল, তাদের কাছে তিনি শুধু একটি নাম ছিলেন না, ছিলেন একটুকরো আশার আলো। তিনি বিশ্বাস করতেন “সম্মান ভিক্ষার মাধ্যমে নয়, সুযোগের মাধ্যমে অর্জিত হয়।” তাই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে অগণিত পরিবারকে স্বনির্ভর করে তুলেছেন, দিয়েছেন আত্মমর্যাদার শক্তি।

তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সীমাহীন। তিনি শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। তাঁর গড়ে তোলা ASA International আজ এশিয়া ও আফ্রিকার ১৭টি দেশে কাজ করছে, আর সেখানে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, দেশের জন্য সম্মান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন।

২০০৬ সালে, যখন তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখনও তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সত্যিকারের নেতৃত্ব সময়ের দৈর্ঘ্যে নয়, প্রভাবের গভীরতায় মাপা হয়। কিন্তু এতসব সাফল্যের পরও তিনি প্রচারের আলো থেকে দূরেই থেকেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত পরিবর্তন করতালির অপেক্ষা করে না, তা কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, এই নীরব যোদ্ধা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও, তাঁর স্বপ্ন আজও বেঁচে আছে। তাঁর শূন্যতা অনুভূত হয়, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি ছড়িয়ে আছে ASA-এর প্রতিটি উদ্যোগে, প্রতিটি পরিবর্তিত জীবনে, প্রতিটি হাসিতে।

আজ আমরা তাঁকে নিয়ে শোক করি না, তাঁকে উদযাপন করি। কারণ, শফিকুল হক চৌধুরীর মতো মানুষ কখনো হারিয়ে যায় না। তারা বেঁচে থাকেন ভালোবাসায়, ছড়িয়ে থাকেন প্রতিটি আলোকিত জীবন ও প্রতিটি মহৎ উদ্যোগে।

তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো মানে শুধু তাঁকে স্মরণ করা নয়, তাঁর স্বপ্নকে বহন করা, তাঁর কাজকে এগিয়ে নেওয়া, এবং বিশ্বাস করা যে, একটিমাত্র সেবামূলক কাজও বদলে দিতে পারে একটি জীবন। শ্রদ্ধা তোমাকে, হে মহান আত্মা। তোমার যাত্রা আমাদের মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকবে।

বাখ//আর

শেয়ার করুন

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আপডেট : ১০:০৫:১৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
৯৭ জন দেখেছেন

শফিকুল হক চৌধুরী : মানবতার এক নিঃশব্দ বিপ্লবী

আপডেট : ১০:০৫:১৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

কেউ স্বপ্ন দেখে, কেউ স্বপ্ন দেখায়, আর কেউ সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে। এটাই নিয়তির নিয়ম। তবে মাঝে মাঝে নিয়তির গণ্ডি ভেঙে কিছু মানুষ এমন এক অধ্যায় রচনা করে, যা সময়ের ক্যানভাসে অমর চিত্র হয়ে থাকে। কেউ হাসায়, কেউ কাঁদায়। কেউ নিজে হাসে, কেউ চোখের জলে ভাসে। আর এর মাঝেই উদিত হয় ব্যতিক্রমী কিছু চরিত্র—রহস্যময়, অভূতপূর্ব, অনন্য।

তেমনি এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের নাম শফিকুল হক চৌধুরী।
তাঁর প্রথম দার্শনিক শিক্ষা ছিল—
“নিয়মের ক্ষেত্রে কঠোর হও, কিন্তু আচরণে হও কোমল।”
“জিহ্বা দিয়ে আঘাত করো না, বরং ভালোবাসার আলিঙ্গনে তোমার উদ্দেশ্য পূরণ করো।”

তিনি শুধু একজন সংগঠক বা নেতা ছিলেন না, ছিলেন এক দার্শনিক, কর্মযোগী এবং নিঃশব্দ বিপ্লবের কারিগর। আজ, তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই মহৎ আত্মাকে, যিনি শুধু নেতৃত্ব দেননি, একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছেন।

কিছু মানুষের পদচিহ্ন এত গভীর হয় যে, সময়ের প্রবাহও তাকে মুছে ফেলতে পারে না। শফিকুল হক চৌধুরী (১৯৪৯-২০২১) ছিলেন তেমনই একজন—একজন যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছিলেন সেইসব মানুষের জন্য, যাদের জন্য সমাজের মূলধারায় স্থান ছিল না।

তিনি জন্মেছিলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের এক ছোট্ট গ্রামে। চাইলে তিনি সহজেই ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির পথে হাঁটতে পারতেন। কিন্তু তিনি এক ভিন্ন পথ বেছে নিলেন—সেবার পথ, ত্যাগের পথ, এক নিঃশব্দ বিপ্লবের পথ। বিসিএস ক্যাডার হিসেবে প্রশিক্ষণ পেলেও, সরকারি চাকরির মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরং, ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আশা’ (ASA), যা হয়ে উঠল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের আলোকবর্তিকা।
যারা দারিদ্র্যের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছিল, তাদের কাছে তিনি শুধু একটি নাম ছিলেন না, ছিলেন একটুকরো আশার আলো। তিনি বিশ্বাস করতেন “সম্মান ভিক্ষার মাধ্যমে নয়, সুযোগের মাধ্যমে অর্জিত হয়।” তাই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে অগণিত পরিবারকে স্বনির্ভর করে তুলেছেন, দিয়েছেন আত্মমর্যাদার শক্তি।

তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সীমাহীন। তিনি শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। তাঁর গড়ে তোলা ASA International আজ এশিয়া ও আফ্রিকার ১৭টি দেশে কাজ করছে, আর সেখানে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, দেশের জন্য সম্মান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন।

২০০৬ সালে, যখন তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখনও তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সত্যিকারের নেতৃত্ব সময়ের দৈর্ঘ্যে নয়, প্রভাবের গভীরতায় মাপা হয়। কিন্তু এতসব সাফল্যের পরও তিনি প্রচারের আলো থেকে দূরেই থেকেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত পরিবর্তন করতালির অপেক্ষা করে না, তা কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, এই নীরব যোদ্ধা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও, তাঁর স্বপ্ন আজও বেঁচে আছে। তাঁর শূন্যতা অনুভূত হয়, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি ছড়িয়ে আছে ASA-এর প্রতিটি উদ্যোগে, প্রতিটি পরিবর্তিত জীবনে, প্রতিটি হাসিতে।

আজ আমরা তাঁকে নিয়ে শোক করি না, তাঁকে উদযাপন করি। কারণ, শফিকুল হক চৌধুরীর মতো মানুষ কখনো হারিয়ে যায় না। তারা বেঁচে থাকেন ভালোবাসায়, ছড়িয়ে থাকেন প্রতিটি আলোকিত জীবন ও প্রতিটি মহৎ উদ্যোগে।

তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো মানে শুধু তাঁকে স্মরণ করা নয়, তাঁর স্বপ্নকে বহন করা, তাঁর কাজকে এগিয়ে নেওয়া, এবং বিশ্বাস করা যে, একটিমাত্র সেবামূলক কাজও বদলে দিতে পারে একটি জীবন। শ্রদ্ধা তোমাকে, হে মহান আত্মা। তোমার যাত্রা আমাদের মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকবে।

বাখ//আর