০১:১৬ অপরাহ্ন, রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সীমান্ত সড়ক পার্বত্য অঞ্চলকে একীভূত করেছে

মো: আজগর আলী খান, নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের ১ দশমাংশ আয়তন জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের কোথাও উঁচু কোথাও নিচু প্রায় দুই থেকে তিন হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়। আবার কোথাও গিরিখাদ। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়াটা আগে যেখানে ছিল অসম্ভব ও অলৌকিক ব্যাপার। বর্তমানে এমন পরিস্থিতিকেও একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্ত সড়ক। দুস্তর, দুর্জয়কে অতিক্রম করে এ যেন এক অসাধ্যকে সাধন করা। সীমান্ত সড়ক পশ্চাৎপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের
স্রোতোধারায় একীভূত করেছে। আর এর পুরোটাই বাস্তবায়ন হতে চলেছে সরকারের  ঐকান্তিক ইচ্ছায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের অংশ হিসেবে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। পুরো পার্বত্য অঞ্চলের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পর্যটন ভ্রমণপিপাসুদের উপভোগ করার সুযোগ করে দিচ্ছে এ সীমান্ত সড়ক। বদলে যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল। বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার একটি অংশ হলো পার্বত্য অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল স্রোতোধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করানো। আর এই পরিকল্পনার প্রতিফলন হচ্ছে এই সীমান্ত সড়ক।
সরকারের চিন্তা ভাবনায়  প্রান্তে-সীমান্তে জনসাধারণের যাতায়াতের সুব্যবস্থা শুধু করছেনই না, পাশাপাশি ওইসব জনপদের আর্থসামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী দেশের সব গ্রামকে আধুনিক শহরে পরিবর্তন করা হচ্ছে। পার্বত্য জনপদকে দেশের অর্থনীতির মূল স্রোতোধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখবে ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সীমান্ত সড়কটি। আধুনিকতার আশীর্বাদে এই দীর্ঘ সীমান্ত সড়কটি পাহাড়ি জনসাধারণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। পার্বত্য অঞ্চল দুর্গম হওয়ায় এ অঞ্চলকে একসময় পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।তিন পার্বত্য জেলায় পাকা রাস্তা নির্মাণ হয়েছে ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার। কাঁচা সড়ক ৭০০ কিলোমিটার, ৬১৪ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার এবং ৯ হাজার ৮৩৯ মিটার ব্রিজ নির্মাণ ও ১৪১টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।  পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় এক বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে।  পার্বত্য চট্টগ্রামের রূপ বদলে দিতে ২০১৯ সালে সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজের সূচনা করা হয়। সীমান্ত সড়ক ঘিরে মানুষ এখন নতুনভাবে স্বপ্ন বুনছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটনশিল্পের প্রসার এবং পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে এ সীমান্ত সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণে পাহাড়ি-বাঙালিরা আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছে। সরকারের এমন সাহসী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দেশের জনসাধারণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়ন সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকা। যাতায়াতব্যবস্থা না থাকায় এ এলাকার উৎপাদিত ফসল রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদরে নিয়ে আসতে আগে দুদিন সময় লেগে যেত।বর্তমানে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হওয়ায় এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কৃষকরা তাদের ফসল রাজস্থলীতে নিয়ে আসতে পারছেন। পার্বত্য অঞ্চলে খুবই মানসম্পন্ন কাজু বাদাম, ড্রাগন, কফি এবং মাল্টাসহ নানা পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে। এগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রসারে সীমান্ত সড়ক সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। এসব কৃষিজাত পণ্যের ওপর ভিত্তি করে এখানে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই এ ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা দুর্গম পাহাড়ের অরক্ষিত এলাকাও পুরোপুরি নজরদারির মধ্যে চলে আসবে। বিস্তৃত এলাকার নিরাপত্তাসহ পর্যটনশিল্প বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে। বেতলিং, সাইচল ও মাঝিরপাড়ায় দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক তৈরির রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্ত সড়কটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে এখানে বিদ্যুৎ, নেটওয়ার্ক সমস্যা থাকবে না, পানির সংকট দূর হবে এবং এখানে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যও গড়ে উঠবে না। আগে কোথাও গেলে যেখানে সারা দিন পার হয়ে যেত এখন তা ঘণ্টায় এসে দাঁড়িয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে এই সীমান্ত সড়ক সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কৃষি খাতে অর্থনীতি সমৃদ্ধিতে এক দারুণ পরিবর্তন এনে দিয়েছে। পাহাড়ি জনপদে এত সুন্দর সড়ক হবে আগে কেউ তা কল্পনাও করেনি। শান্তির সুবাতাস পাহাড়ে বহমান থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর থেকে বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া থেকে জুরাইছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। এ সড়কটি বরকল ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা হয়ে রামগড় উপজেলা সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে। পুরো রাস্তাটি সীমান্ত-সংলগ্ন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ বাস্তবায়িত হবে। একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শুরু হওয়া এই সড়ক ৩ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩১৭ কিলোমিটারের কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। পরবর্তী ৬৬৭ কিলোমিটার কাজ দ্বিতীয় ও তৃতীয়পর্যায় বাস্তবায়ন হলে সীমান্তবর্তী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলা সংযুক্ত হবে।
২০৩৬ সালের মধ্যে ১০৩৬ কিমি সড়ক কাজ শেষ হওয়ার কথা। পুরো কাজ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে দীর্ঘ এই সীমান্ত সড়কটি অদূর ভবিষ্যতে ভারতের মিজোরামণ্ডত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করবে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উঁচু সড়ক নির্মাণের কৃতিত্ব পাবে এ সীমান্ত সড়ক, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতার রেকর্ড হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বান্দরবানে নির্মিত থানচি-আলীকদম সড়কটি ছিল এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতার ছিল সড়কটি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীন ২০, ২৬ ও ১৭ ইসিবি সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকৃতিকে অক্ষত রেখে কাজের গুণগতমান বজায়, পর্যটকবান্ধব এই সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে উঁচু পাহাড়, গভীর খাদ, ভূমিধস, প্রকৃতির বৈরী আচরণ, আঞ্চলিক সংগঠনের অপতৎপরতা, পরিবহন ও যোগাযোগ সংকটসহ জটিল পরিস্থিতিগুলো মোকাবিলা করে সড়কটির উন্নয়নকাজ পরিচালনা করে চলেছে।
সীমান্ত সড়ক নির্মাণ দেশের পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন খাত, কৃষি খাত এবং ফলদ চাষাবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় এক নতুন সম্ভাবনা সঞ্চারিত হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ইতিমধ্যে উৎকৃষ্টমানের ড্রাগন, কফি, কাজুবাদাম, কমলা-মাল্টা, ইক্ষু, আনারস, আম, কলাসহ নানা কৃষি ও ফল-ফলাদি উৎপাদন শুরু হয়েছে। সীমান্ত সড়ক পার্বত্য অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিজ ও ফলদ দ্রুত পরিবহন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। কৃষি সম্ভাবনার সহজ যোগাযোগের স্থান নির্বাচনে একসময় এখানে অনেক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। যার ফলে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালিদের কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনই স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটবে।
সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে পার্বত্য অঞ্চল তথা দেশের মানুষের ভাগ্যের দ্বার খুলে যাবে। এখানে নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ঘটবে। অবৈধ চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র পাচার, মাদক পাচার বন্ধ হবে। এ ছাড়া দেশের অর্থকরী ফসল পরিবহন সুবিধা, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি, সীমান্ত অঞ্চলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ পুরো পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার হবে। এক কথায়, পশ্চাৎপদ পার্বত্য অঞ্চল একসময় সমৃদ্ধিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হবে।
বাক//আর

শেয়ার করুন

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আপডেট : ০৩:৪৩:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
১১৬ জন দেখেছেন

সীমান্ত সড়ক পার্বত্য অঞ্চলকে একীভূত করেছে

আপডেট : ০৩:৪৩:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের ১ দশমাংশ আয়তন জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের কোথাও উঁচু কোথাও নিচু প্রায় দুই থেকে তিন হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়। আবার কোথাও গিরিখাদ। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়াটা আগে যেখানে ছিল অসম্ভব ও অলৌকিক ব্যাপার। বর্তমানে এমন পরিস্থিতিকেও একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্ত সড়ক। দুস্তর, দুর্জয়কে অতিক্রম করে এ যেন এক অসাধ্যকে সাধন করা। সীমান্ত সড়ক পশ্চাৎপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের
স্রোতোধারায় একীভূত করেছে। আর এর পুরোটাই বাস্তবায়ন হতে চলেছে সরকারের  ঐকান্তিক ইচ্ছায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের অংশ হিসেবে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। পুরো পার্বত্য অঞ্চলের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পর্যটন ভ্রমণপিপাসুদের উপভোগ করার সুযোগ করে দিচ্ছে এ সীমান্ত সড়ক। বদলে যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল। বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার একটি অংশ হলো পার্বত্য অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল স্রোতোধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করানো। আর এই পরিকল্পনার প্রতিফলন হচ্ছে এই সীমান্ত সড়ক।
সরকারের চিন্তা ভাবনায়  প্রান্তে-সীমান্তে জনসাধারণের যাতায়াতের সুব্যবস্থা শুধু করছেনই না, পাশাপাশি ওইসব জনপদের আর্থসামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী দেশের সব গ্রামকে আধুনিক শহরে পরিবর্তন করা হচ্ছে। পার্বত্য জনপদকে দেশের অর্থনীতির মূল স্রোতোধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখবে ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সীমান্ত সড়কটি। আধুনিকতার আশীর্বাদে এই দীর্ঘ সীমান্ত সড়কটি পাহাড়ি জনসাধারণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। পার্বত্য অঞ্চল দুর্গম হওয়ায় এ অঞ্চলকে একসময় পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।তিন পার্বত্য জেলায় পাকা রাস্তা নির্মাণ হয়েছে ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার। কাঁচা সড়ক ৭০০ কিলোমিটার, ৬১৪ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার এবং ৯ হাজার ৮৩৯ মিটার ব্রিজ নির্মাণ ও ১৪১টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।  পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় এক বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে।  পার্বত্য চট্টগ্রামের রূপ বদলে দিতে ২০১৯ সালে সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজের সূচনা করা হয়। সীমান্ত সড়ক ঘিরে মানুষ এখন নতুনভাবে স্বপ্ন বুনছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটনশিল্পের প্রসার এবং পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে এ সীমান্ত সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণে পাহাড়ি-বাঙালিরা আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছে। সরকারের এমন সাহসী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দেশের জনসাধারণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়ন সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকা। যাতায়াতব্যবস্থা না থাকায় এ এলাকার উৎপাদিত ফসল রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদরে নিয়ে আসতে আগে দুদিন সময় লেগে যেত।বর্তমানে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হওয়ায় এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কৃষকরা তাদের ফসল রাজস্থলীতে নিয়ে আসতে পারছেন। পার্বত্য অঞ্চলে খুবই মানসম্পন্ন কাজু বাদাম, ড্রাগন, কফি এবং মাল্টাসহ নানা পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে। এগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রসারে সীমান্ত সড়ক সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। এসব কৃষিজাত পণ্যের ওপর ভিত্তি করে এখানে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই এ ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা দুর্গম পাহাড়ের অরক্ষিত এলাকাও পুরোপুরি নজরদারির মধ্যে চলে আসবে। বিস্তৃত এলাকার নিরাপত্তাসহ পর্যটনশিল্প বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে। বেতলিং, সাইচল ও মাঝিরপাড়ায় দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক তৈরির রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্ত সড়কটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে এখানে বিদ্যুৎ, নেটওয়ার্ক সমস্যা থাকবে না, পানির সংকট দূর হবে এবং এখানে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যও গড়ে উঠবে না। আগে কোথাও গেলে যেখানে সারা দিন পার হয়ে যেত এখন তা ঘণ্টায় এসে দাঁড়িয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে এই সীমান্ত সড়ক সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কৃষি খাতে অর্থনীতি সমৃদ্ধিতে এক দারুণ পরিবর্তন এনে দিয়েছে। পাহাড়ি জনপদে এত সুন্দর সড়ক হবে আগে কেউ তা কল্পনাও করেনি। শান্তির সুবাতাস পাহাড়ে বহমান থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর থেকে বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া থেকে জুরাইছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। এ সড়কটি বরকল ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা হয়ে রামগড় উপজেলা সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে। পুরো রাস্তাটি সীমান্ত-সংলগ্ন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ বাস্তবায়িত হবে। একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শুরু হওয়া এই সড়ক ৩ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩১৭ কিলোমিটারের কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। পরবর্তী ৬৬৭ কিলোমিটার কাজ দ্বিতীয় ও তৃতীয়পর্যায় বাস্তবায়ন হলে সীমান্তবর্তী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলা সংযুক্ত হবে।
২০৩৬ সালের মধ্যে ১০৩৬ কিমি সড়ক কাজ শেষ হওয়ার কথা। পুরো কাজ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে দীর্ঘ এই সীমান্ত সড়কটি অদূর ভবিষ্যতে ভারতের মিজোরামণ্ডত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করবে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উঁচু সড়ক নির্মাণের কৃতিত্ব পাবে এ সীমান্ত সড়ক, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতার রেকর্ড হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বান্দরবানে নির্মিত থানচি-আলীকদম সড়কটি ছিল এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতার ছিল সড়কটি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীন ২০, ২৬ ও ১৭ ইসিবি সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকৃতিকে অক্ষত রেখে কাজের গুণগতমান বজায়, পর্যটকবান্ধব এই সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে উঁচু পাহাড়, গভীর খাদ, ভূমিধস, প্রকৃতির বৈরী আচরণ, আঞ্চলিক সংগঠনের অপতৎপরতা, পরিবহন ও যোগাযোগ সংকটসহ জটিল পরিস্থিতিগুলো মোকাবিলা করে সড়কটির উন্নয়নকাজ পরিচালনা করে চলেছে।
সীমান্ত সড়ক নির্মাণ দেশের পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন খাত, কৃষি খাত এবং ফলদ চাষাবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় এক নতুন সম্ভাবনা সঞ্চারিত হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ইতিমধ্যে উৎকৃষ্টমানের ড্রাগন, কফি, কাজুবাদাম, কমলা-মাল্টা, ইক্ষু, আনারস, আম, কলাসহ নানা কৃষি ও ফল-ফলাদি উৎপাদন শুরু হয়েছে। সীমান্ত সড়ক পার্বত্য অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিজ ও ফলদ দ্রুত পরিবহন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। কৃষি সম্ভাবনার সহজ যোগাযোগের স্থান নির্বাচনে একসময় এখানে অনেক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। যার ফলে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালিদের কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনই স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটবে।
সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে পার্বত্য অঞ্চল তথা দেশের মানুষের ভাগ্যের দ্বার খুলে যাবে। এখানে নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ঘটবে। অবৈধ চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র পাচার, মাদক পাচার বন্ধ হবে। এ ছাড়া দেশের অর্থকরী ফসল পরিবহন সুবিধা, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি, সীমান্ত অঞ্চলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ পুরো পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার হবে। এক কথায়, পশ্চাৎপদ পার্বত্য অঞ্চল একসময় সমৃদ্ধিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হবে।
বাক//আর