০৭:২৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংরক্ষণের জায়গার অভাবে বিপাকে কৃষক

ফুলবাড়ীতে হিমাগারে আলু রাখতে আলু চাষিদের দীর্ঘ লাইন

মোঃ আবু শহীদ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি

কৃষক মোমিনুল ইসলাম বাড়ী দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার খট্টামাধবপুর ডাঙ্গাপাড়া এলাকায়। এবার তিন বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছেন। একটি ট্রাক্টরে করে ১৮ বস্তা আলু নিয়ে ফুলবাড়ী উপজেলার রাঙামাটিস্থ ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজে এসেছেন। সিরিয়ালের কোনো স্লিপ পাননি। আদৌ আলু হিমাগারে রাখতে পারবেন কি না? তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। জায়গা না পেলে হয়তো ফিরে যেতে হবে তাকে। এতে একদিকে সময়ের অপচয়, অন্যদিকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি গাড়ি ভাড়া। একে তো আলুর দাম কম, অপরদিকে সংরক্ষনের জায়গার অভাবে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষক মোমিনুল ইসলাম মতো এমন ভোগান্তিতে পড়েছেন একই এলাকার কৃষক এরশাদ আলী, ডাঙ্গাপাড়া এলাকার জাকিরুল ইসলাম, কবির হোসেন, ভবানীপুর এলাকার মো. নূরুন্নবীসহ অন্তত শতাধিক আলু চাষি।

সরেজমিনে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ক্লোল্ড স্টোরেজ হিমাগার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হিমাগারের ভেতরে অন্তত শতাধিক ট্রাক্টর, ভটভটি ও ব্যাটারি চালিত ভ্যান ভর্তি আলু নিয়ে হিমাগারে ঢোকানোর অপেক্ষায় কৃষক। হিমাগারের ভেতরের অংশের পাশাপাশি ভেতরের ঢোকার অপেক্ষায় বাইরেও অবস্থান করছে অন্তত শতাধিক ট্রাক্টর ভর্তি আলু।মোমনিুল ইসলাম বলেন, ‘আলুর গাড়িতে ঘুমাতে হচ্ছে। ড্রাইভার-হেলপারও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। এবার আলুর ফলন ভালো হলেও দাম কম। ফলে পরবর্তী সময়ে ভালো দাম পেতে সবাই হিমাগারে আলু রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

কৃষকদের মধ্যে অনেকেরই অভিযোগ, হিমাগারে আলু ভর্তি করতে কৃষকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে দ্রæত সিরিয়াল পেতে সহায়তা করছেন হিমাগারের কমিশন এজেন্টরা। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করছেন ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মাহামুুদুল হাসান।

দিনাজপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও ঘোড়াঘাট এই পাঁচ উপজেলার মধ্যে একটি মাত্র হিমাগার রয়েছে ফুলবাড়ীতে। মৌসুমের শুরু থেকেই হিমাগারের সামনে আলু বোঝাই গাড়ির দীর্ঘ সারি। কেউ উৎপাদিত আলু নিয়ে নিজে এসেছেন, কেউবা এজেন্টের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। নবাবগঞ্জের আফতাবগঞ্জ এলাকার নারী কৃষক বিজলী রানী আগামী বছরে আবাদের জন্য বীজের জন্য ৫৫ কেজি ওজনের দুই বস্তা আলু নিয়ে এসেছেন হিমাগারে, সিরিয়াল পাননি তিনি।

লোহাচড়া ডাঙ্গাপাড়া এলাকার কৃষক নূরুন্নবী বলেন, যে পরিমাণ জমিতে আলু আবাদ করেছেন তার বেশির ভাগ আলু হাটবাজারে বিক্রি করে উৎপাদন খরচ মিটিয়েছেন। শুনেছেন এবার হিমাগারে জায়গা নেই, তারপরও এলাকার কয়েকজন কৃষক তিন ট্রাক্টরে (৫৫ কেজি ওজনের) ১২০ বস্তা আলু নিয়ে এসেছেন ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজে। গাড়ী ভাড়া দ্বিগুণ পড়েছে, তারপরও লাভের আশায় আলু রাখতে চান। কারণ এখন বাজারে আলুর দাম প্রকার ভেদে প্রতি কেজি ১১ থেকে ১৩ টাকা, পরে যদি দাম বাড়ে।

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছর জেলায় আলু আবাদ হয়েছিল ৪৫ হাজার ৮২৮ হেক্টর জমিতে। এবার সেখানে ৫৬ হাজার ৬৫১ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৯ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ফুলবাড়ী উপজেলাতেই আলু আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন।

ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দিয়ে হিমাগারে আলু ঢোকানো হচ্ছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে কৃষকদের আগ্রাধিকার দিয়েই আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোল্ড স্টোরেজের ধারণ ক্ষমতা ৬০ কেজি ওজনের ১ লাখ ৬০ হাজার বস্তা। ইতোমধ্যে আলু সংগ্রহ ধারণ ক্ষমতা পুরন হয়েছে। এরপরও কৃষকদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে হিমাগারের প্রাথমিক শীতলীকরণ (অতিরিক্ত) জায়গায় কিছু বস্তা রাখার চেষ্টা করছি।

এরপরেও হাজার হাজার বস্তা আলু নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে। জায়গার অভাবে উপাই না পেয়ে কৃষকদের ফেরত দিতে হচ্ছে । ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, গত বছর এ উপজেলায় আলু আবাদ হয়েছিল ১ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে, সেখানে এ বছর আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে ৪৫ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ১০০ হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকাসহ প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ না আসায় আলুর আবাদ ও ফলন দুই-ই ভালো হয়েছে।

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. আনিছুজ্জামান বলেন, আলুর দাম কমে যাওয়ায় কৃষকদের পাশাপাশি আলু সংরক্ষণের দিকে ঝুকেছেন ব্যবসায়ীরাও। এতে করে প্রত্যেকটি হিমাগারের ওপর চাপ বেড়েছে। আলু সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে আলুর আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে, এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।

বাখ//আর

শেয়ার করুন

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আপডেট : ০৬:২৬:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
৭৮ জন দেখেছেন

সংরক্ষণের জায়গার অভাবে বিপাকে কৃষক

ফুলবাড়ীতে হিমাগারে আলু রাখতে আলু চাষিদের দীর্ঘ লাইন

আপডেট : ০৬:২৬:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫

কৃষক মোমিনুল ইসলাম বাড়ী দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার খট্টামাধবপুর ডাঙ্গাপাড়া এলাকায়। এবার তিন বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছেন। একটি ট্রাক্টরে করে ১৮ বস্তা আলু নিয়ে ফুলবাড়ী উপজেলার রাঙামাটিস্থ ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজে এসেছেন। সিরিয়ালের কোনো স্লিপ পাননি। আদৌ আলু হিমাগারে রাখতে পারবেন কি না? তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। জায়গা না পেলে হয়তো ফিরে যেতে হবে তাকে। এতে একদিকে সময়ের অপচয়, অন্যদিকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি গাড়ি ভাড়া। একে তো আলুর দাম কম, অপরদিকে সংরক্ষনের জায়গার অভাবে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষক মোমিনুল ইসলাম মতো এমন ভোগান্তিতে পড়েছেন একই এলাকার কৃষক এরশাদ আলী, ডাঙ্গাপাড়া এলাকার জাকিরুল ইসলাম, কবির হোসেন, ভবানীপুর এলাকার মো. নূরুন্নবীসহ অন্তত শতাধিক আলু চাষি।

সরেজমিনে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ক্লোল্ড স্টোরেজ হিমাগার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হিমাগারের ভেতরে অন্তত শতাধিক ট্রাক্টর, ভটভটি ও ব্যাটারি চালিত ভ্যান ভর্তি আলু নিয়ে হিমাগারে ঢোকানোর অপেক্ষায় কৃষক। হিমাগারের ভেতরের অংশের পাশাপাশি ভেতরের ঢোকার অপেক্ষায় বাইরেও অবস্থান করছে অন্তত শতাধিক ট্রাক্টর ভর্তি আলু।মোমনিুল ইসলাম বলেন, ‘আলুর গাড়িতে ঘুমাতে হচ্ছে। ড্রাইভার-হেলপারও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। এবার আলুর ফলন ভালো হলেও দাম কম। ফলে পরবর্তী সময়ে ভালো দাম পেতে সবাই হিমাগারে আলু রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

কৃষকদের মধ্যে অনেকেরই অভিযোগ, হিমাগারে আলু ভর্তি করতে কৃষকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে দ্রæত সিরিয়াল পেতে সহায়তা করছেন হিমাগারের কমিশন এজেন্টরা। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করছেন ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মাহামুুদুল হাসান।

দিনাজপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও ঘোড়াঘাট এই পাঁচ উপজেলার মধ্যে একটি মাত্র হিমাগার রয়েছে ফুলবাড়ীতে। মৌসুমের শুরু থেকেই হিমাগারের সামনে আলু বোঝাই গাড়ির দীর্ঘ সারি। কেউ উৎপাদিত আলু নিয়ে নিজে এসেছেন, কেউবা এজেন্টের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। নবাবগঞ্জের আফতাবগঞ্জ এলাকার নারী কৃষক বিজলী রানী আগামী বছরে আবাদের জন্য বীজের জন্য ৫৫ কেজি ওজনের দুই বস্তা আলু নিয়ে এসেছেন হিমাগারে, সিরিয়াল পাননি তিনি।

লোহাচড়া ডাঙ্গাপাড়া এলাকার কৃষক নূরুন্নবী বলেন, যে পরিমাণ জমিতে আলু আবাদ করেছেন তার বেশির ভাগ আলু হাটবাজারে বিক্রি করে উৎপাদন খরচ মিটিয়েছেন। শুনেছেন এবার হিমাগারে জায়গা নেই, তারপরও এলাকার কয়েকজন কৃষক তিন ট্রাক্টরে (৫৫ কেজি ওজনের) ১২০ বস্তা আলু নিয়ে এসেছেন ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজে। গাড়ী ভাড়া দ্বিগুণ পড়েছে, তারপরও লাভের আশায় আলু রাখতে চান। কারণ এখন বাজারে আলুর দাম প্রকার ভেদে প্রতি কেজি ১১ থেকে ১৩ টাকা, পরে যদি দাম বাড়ে।

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছর জেলায় আলু আবাদ হয়েছিল ৪৫ হাজার ৮২৮ হেক্টর জমিতে। এবার সেখানে ৫৬ হাজার ৬৫১ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৯ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ফুলবাড়ী উপজেলাতেই আলু আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন।

ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দিয়ে হিমাগারে আলু ঢোকানো হচ্ছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে কৃষকদের আগ্রাধিকার দিয়েই আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোল্ড স্টোরেজের ধারণ ক্ষমতা ৬০ কেজি ওজনের ১ লাখ ৬০ হাজার বস্তা। ইতোমধ্যে আলু সংগ্রহ ধারণ ক্ষমতা পুরন হয়েছে। এরপরও কৃষকদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে হিমাগারের প্রাথমিক শীতলীকরণ (অতিরিক্ত) জায়গায় কিছু বস্তা রাখার চেষ্টা করছি।

এরপরেও হাজার হাজার বস্তা আলু নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে। জায়গার অভাবে উপাই না পেয়ে কৃষকদের ফেরত দিতে হচ্ছে । ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, গত বছর এ উপজেলায় আলু আবাদ হয়েছিল ১ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে, সেখানে এ বছর আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে ৪৫ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ১০০ হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকাসহ প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ না আসায় আলুর আবাদ ও ফলন দুই-ই ভালো হয়েছে।

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. আনিছুজ্জামান বলেন, আলুর দাম কমে যাওয়ায় কৃষকদের পাশাপাশি আলু সংরক্ষণের দিকে ঝুকেছেন ব্যবসায়ীরাও। এতে করে প্রত্যেকটি হিমাগারের ওপর চাপ বেড়েছে। আলু সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে আলুর আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে, এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।

বাখ//আর