দিনাজপুরে লিচুর মৌ মৌ গন্ধে মৌমাছির উৎসব! মুকুলে ভরে গেছে বাগান, আশায় কৃষক-ব্যবসায়ী

মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই..নব কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কবিতার বাস্তব রূপ যেন এখন দিনাজপুরের লিচুবাগানগুলোতে। চারদিকে লিচুর মুকুলের মোহময় সুবাস, আর সেই ঘ্রাণে উড়ছে হাজারো মৌমাছি। প্রকৃতির এই ব্যস্ততা যেন জানান দিচ্ছে, সামনে আসছে প্রকৃতির রসগোল্লা নামক স্বাদে-গন্ধে অনন্য দিনাজপুরের বিখ্যাত লিচু।
লিচুর রাজ্য বাংলাদেশের লিচু উৎপাদনের সিংহভাগই আসে দিনাজপুর থেকে। জেলার ১৩টি উপজেলার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে বোম্বাই, মাদ্রাজি, বেদানা, চায়না থ্রি, এলাচি ও কাঠালি সহ বিভিন্ন উন্নত জাতের লিচু চাষ হয়। প্রতি মৌসুমে প্রায় ৭০ লাখ টন লিচু উৎপাদিত হয়, যা বাজারে হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মাধববাটি গ্রাম সবচেয়ে বেশি লিচু উৎপাদন করে। এখানে ২১৫০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়, যা জেলার মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক! যাদের হাতে দিনাজপুরে লিচুর গড়াপত্তন এই অঞ্চলে লিচু চাষের সূচনা করেছিলেন কিছু উদ্ভাবনী চিন্তার মানুষ—প্রয়াত হাজী শামসুদ্দিন, প্রয়াত শাহ ইব্রাহিম, প্রয়াত শাহ্ জহুরুল ইসলাম, প্রয়াত মৌলভী ইউসুফ আলী তাদের প্রচেষ্টায় লিচু চাষ এ অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে এবং দিনাজপুর আজ দেশের অন্যতম লিচু উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
কৃষকদের আশা ও চ্যালেঞ্জ বাগান মালিক আবু তাহের জানান, ৭০-৭৫% গাছে মুকুল এসেছে, যা ভালো ফলনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি আশাবাদী, এবার লিচুর ‘রসগোল্লা’ সময়মতো গাছে ধরবে এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাবে।
তবে লিচু চাষি আব্দুস সবুর কিছুটা চিন্তিত। তার চারটি বাগানের মধ্যে দুইটিতে মাত্র ৫০% গাছে মুকুল এসেছে, বাকি দুইটিতে তুলনামূলক কম। গেলো বছরের তুলনায় এবার মুকুল কিছুটা কম হলেও, সঠিক পরিচর্যায় ভালো ফলনের সম্ভাবনা আছে বলে তিনি মনে করেন।
লিচু ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান বলেন, মুকুলের সংখ্যা কম হলেও যদি গুণগত মান ঠিক থাকে, তাহলে ব্যবসা ভালো হবে। তবে গেল বছর প্রচণ্ড রোদে অনেক লিচু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যা নিয়ে এবারও ব্যবসায়ীরা কিছুটা চিন্তিত।
বুনিয়াদপুর গ্রামের বিশিষ্ট লিচু ব্যবসায়ী আনারুল ইসলাম জানালেন, তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকার বাগান কিনেছেন। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তবে প্রকৃতি অনুকূল থাকলে ভালো লাভ হবে বলে আশা করছেন তিনি।
মধুর রাজ্যে মৌয়ালদের কর্মব্যস্ততা লিচুর মুকুল মানেই শুধু সুস্বাদু লিচুর আগমনী বার্তা নয়, এটি মৌয়ালদের জন্যও সোনালী সুযোগ। ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৌয়ালরা দিনাজপুরে ছুটে এসেছে মধু সংগ্রহ করতে।
মৌয়াল শহিদুল ইসলাম জানান, তিনি ২০০০টি মৌ বাক্স নিয়ে এসেছেন। প্রচুর মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, তবে সমস্যা একটাই—সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্য দাম পাওয়া কঠিন। সরকারের কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, দিনাজপুর জেলায় প্রতি মৌসুমে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করা হয়, যা দেশের অন্যতম সেরা মধু হিসেবে বিবেচিত।
কৃষি বিভাগের প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনা দিনাজপুরের কৃষি কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই মাঠপর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ফরিদুল ইসলাম জানান, আর কিছুদিন পরেই লিচুর গুটি বের হবে, তখন নানা রোগবালাই থেকে রক্ষার জন্য কৃষকদের আগেভাগেই ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তা মুস্তাফা হোসেন ইমাম বলেন, নিরাপদ ও বিষমুক্ত লিচু উৎপাদনে কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। গেলো বছর প্রচণ্ড গরমে কিছু লিচু ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এবার মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা সরাসরি চাষিদের পাশে থেকে তাদের সাহায্য করছেন।
উপসংহার দিনাজপুরের লিচুবাগান এখন উৎসবের আমেজে। মৌমাছির গুঞ্জন, কৃষকদের ব্যস্ততা, মৌয়ালদের কর্মচাঞ্চল্য—সব মিলিয়ে এক অনন্য দৃশ্য। প্রকৃতি সহায় হলে এ বছরও দিনাজপুরের লিচু দেশের বাজার মাতাবে এবং ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন।
বাখ//আর