উত্তরবঙ্গের মধু শিল্প
সম্ভাবনার অপার দ্বার, সুবিধার অভাবে পিছিয়ে মৌয়ালরা

ব্যস্ত মৌমাছি, পুরো মাথা জাল দিয়ে ঢাকা মৌয়াল, আর চারদিকে সারি সারি মৌ বক্স—এ যেন এক মহাযজ্ঞ! দিনাজপুরের লিচুর বাগানগুলোতে এখন চলছে মধু আহরণের মৌসুম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত হাজারো মৌয়াল কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন মধু সংগ্রহে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে প্রতিবছর প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না, যা দেশের মধু শিল্পের এক বিশাল সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
লিচুর মৌসুমে মৌয়ালদের ব্যস্ত সময়: দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১৩টি উপজেলায় প্রায় ৬,০০০টি লিচু বাগান রয়েছে। মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২,০০০ মৌয়াল আসেন মধু সংগ্রহ করতে। তবে জেলার মোট লিচু বাগানের মাত্র ৩০-৪০% বাগান থেকেই মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মৌয়াল মোঃ শহিদুল ইসলাম জানান, তিনি এবার ১,০০০টি মৌ বক্স নিয়ে এসেছেন এবং কয়েকজন সহকারীসহ বিরল উপজেলার বিভিন্ন বাগানে মধু সংগ্রহ করছেন। তিনি বলেন,”যদি দেশীয় মধু উৎপাদনের দিকে সরকার আরও গুরুত্ব দিত, তাহলে বিদেশ থেকে মধু আমদানি কমিয়ে আমরা নিজেদের উৎপাদিত মধু দিয়েই চাহিদা মেটাতে পারতাম। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে আমরা ন্যায্য দাম পাই না, যা আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা।”
উৎপাদন কম, দামও কম—মৌয়ালদের দুঃখের গল্প: সরকারি খামারি সাইফুল ইসলাম জানান, তাদের গ্রামের প্রায় ৬০০ জন মৌয়াল মধু সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত। কিন্তু মধুর বাজারদর কম হওয়ায় তারা ন্যায্য মূল্য পান না।
আরেক খামারি মোঃ সাইদুর রহমান বলেন, “সরকার যদি আমাদের মৌয়ালদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিত এবং বিপণন ব্যবস্থা উন্নত করত, তাহলে আমরা ন্যায্য দাম পেতাম ও কর্মসংস্থানও বাড়ত।”
পরাগায়নে মৌয়ালদের ভূমিকা এবং লিচুর উৎপাদন সংকট: লিচু ব্যবসায়ী ও বাগান মালিক আবু তাহের বলেন,”বেশি মৌয়াল আসলে পরাগায়ন ভালো হয়, ফলে লিচুর উৎপাদনও বাড়ে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে মৌয়ালদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় লিচুর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।”
স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, “এবার লিচু গাছে ভালো মুকুল এসেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৌয়ালরা আসছেন, আগামীতে আরও আসবেন। আমরা চেষ্টা করছি তাদের জন্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে।” সরকারি সহায়তা পেলে হাজার কোটি টাকার সম্ভাবনা উত্তরবঙ্গ হানি কমিউনিটি ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “যদি মৌয়ালদের থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে প্রতি মৌসুমে ১,০০০ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ করা সম্ভব। পাশাপাশি লিচুর উৎপাদন হতে পারে প্রায় ১ লক্ষ মেট্রিক টন।”
প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে বিদেশ থেকে নামিদামি মধু আমদানি করা হয়। অথচ দেশীয় মধু প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণের জন্য সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হতো এবং দেশীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ত।
সঠিক পরিকল্পনায় উজ্জ্বল ভবিষ্যত: দিনাজপুরের মধু শিল্প শুধু মৌয়ালদের জন্য নয়, কৃষকদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৌমাছি পরাগায়নের মাধ্যমে লিচুর উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যা দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। সরকার যদি মধু উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাকে আধুনিক করে এবং মৌয়ালদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে, তাহলে এই শিল্পটি দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে।
বাখ//আর